আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, ২৫ মে বুধবার। গানের বুলবুল নামে খ্যাত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তিনদিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। নজরুল জন্মবার্ষিকীতে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘বিদ্রোহী’র শতবর্ষ’।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার সকাল সাড়ে ৬টায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের নেতৃত্বে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটসহ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দফতর-সংস্থাগুলো কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে। এ বছর বিদ্রোহী কবির জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে নজরুল স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লায়।
এদিকে,চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো: আশরাফ উদ্দিন।
উল্লেখ্য, গত ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার হলে জাতীয় কমিটির সভায় এসব কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে, বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ, মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। সন্তান হওয়ার পর–পরই অন্যান্য ছেলেরা মারা যাওয়ায় নজরুলের দাদি তার নাম রেখেছিলো দুখু মিয়া। এই দুখু মিয়াই একদিন মহীরূহ মহাকবিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পর তার মতো বড় কবি বঙ্গদেশে আর জন্মগ্রহণ করেন নি।
কাজী নজরুল ইসলামের শৈশব কেটেছে নানা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে। তার পিতা ছিলেন একমাজারের খাদেম এবং এক মসজিদের ইমাম। নজরুলের বয়স যখন দশ বছর তখন তার বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর মাদ্রাসায় পড়া বন্ধ করে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন এবং মাত্র দু’বছরের মধ্যে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষা বেশ ভালোভাবেই পাস করে ফেলেন। এগারো–বারো বছর বয়সে স্কুলের বাঁধাধরা পড়া ছেড়ে গ্রাম্য এক লেটোর দলে যোগদান করেন। এই লেটোর দলের জন্যে ঐ বয়সেই তিনি চাষার সং, রাজপূত, মেঘনাদবধ ইত্যাদি কয়েকটা পালাগান লিখলেন এবং সুর দিলেন। বয়স কৈশোরে পৌঁছাতেই তিনি লেটোর দলের সর্দার হয়ে গেলেন।
আস্তে আস্তে কাজী নজরুল ইসলাম মুখে মুখে ছড়াগান ও কবিতা রচনায় পারদর্শী হয়ে ওঠলেন। এসময় তিনি স্কুলের বাঁধাধরা পড়াশুনা না করলেও বাংলা ভাষায় অনেক বই এবং হিন্দু-মুসলমান ধর্ম শাস্ত্রের বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এরপর তিনি রানীগঞ্জের এক স্কুলে ভর্তি হন।
কাজী নজরুল ইসলাম রানীগঞ্জের এক স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বর্ধমান জেলার মহকুমা শহরে আসানসোলে পালিয়ে আসেন। সেখানে এক রুটির দোকানে পাঁচ টাকা মাসিক বেতনে রুটি বানানোর চাকরি নিলেন। সেখানকার এক দারোগা কাজী রফিকউদ্দিন গান বাজনা ও কবিতার প্রতি ঝোক দেখে নজরুলকেতার ময়মনসিংহস্থ নিজ গ্রামে কাজীর সিমলায় নিয়ে আসেন। এখানে তিনি তাকে এক স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আবার রানীগঞ্জে ফিরে এলেন। এর ফাঁকে ফাঁকে নানা ধরনের সাহিত্য আর কবিতার বই পড়ে নিজের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে লাগলেন।
নজরুল তখন দশম শ্রেণীতে পড়েন, ম্যাট্রিক পরীক্ষার পূর্বে টেস্ট পরীক্ষা এসে গেল। কিন্তু ১৯১৭ সালে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। কাজী নজরুল ইসলাম স্থির করলেন যুদ্ধে যোগ দেবেন। ১৯১৭ সালে নজরুল ৪৯ নম্বর বাঙালী পল্টনে যোগগ দিয়ে গেলেন নওশেরায়। সেখান থেকে করাচিতে। করাচি সেনানিবাসে তার সঙ্গে আলাপ হয় এক সহকর্মী পাঞ্জাবি মৌলভীর সঙ্গে। ফার্সি ভাষায় তার দক্ষতা ছিলো গভীর। নজরুল তার কাছে ফার্সি ভাষার কালজয়ী প্রতিভা হাফিজ, শেখ সাদী, রুমি, ওমর খৈয়াম প্রমুখের রচনাসম্ভার সম্বন্ধে পাঠ নেন। এখান থেকেই নজরুল সৃষ্টিধর্মী কবিতা, গল্প, গান, গজল, উপন্যাস প্রভৃতি লেখার জন্য অন্তরের তাগিত অনুভব করলেন। বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখে নজরুল কলকাতার নামকরা পত্রিকায় পাঠাতে লাগলেন। সেগুলো যথামৰ্যাদায় ছাপাও হতে লাগলো। ১৯১৯ সালে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়ায় নজরুল দেশে ফিরে এসে পুরোদমে কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করলেন।
নজরুল ‘ধূপছায়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এটিতে তিনি একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’ ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত ‘গৃহদাহ’ চলচ্চিত্রের সুরকার ছিলেন তিনি। গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ১৯৩৩ সালে পায়োনিয়ার ফিল্মস কোম্পানির প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ধ্রুব’ এবং সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ১৯৩৭ সালের ‘গ্রহের ফের’ চলচ্চিত্রের ১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাতালপুরী’ চলচ্চিত্রের ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৩৮ সালে নির্মিত ‘গোরা’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নজরুল।
মাত্র বাইশ বছর বয়সে নজরুল লিখে ফেললেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী ’। এই কবিতাটি রচনা করে কাজী নজরুল ইসলাম বিখ্যাত হয়ে গেলেন ‘বিদ্রোহী’ কবি হিসেবে। দেশে প্রচুর সাড়া পড়ে গেল। এই একটি মাত্র কবিতার জন্য নজরুলকে চিরঞ্জীব পরিচিতি দান করেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাকে সমাদরে স্বাগত জানিয়ে আশীর্বাদ করলেন। তারপরের ইতিহাস বিজয়ের ইতিহাস, গৌরবের ইতিহাস,অমরত্বের ইতিহাস ।
‘মে ভুখাহু’ শীর্ষক প্রবন্ধ ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশের পর ১৯২৩ খ্রি. ১৬ জানুয়ারি রাজদ্রোহের অভিযোগে নজরুলের এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল প্রমীলা সেনগুপ্তাকে বিয়ে করেন। তার স্ত্রী প্রমীলা পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় মারা যান।
১৯২৬ খ্রি. কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সেসময় কবি কৃষ্ণনগরে লিখলেন কাণ্ডারী হুশিয়ার , দেশবন্ধুর স্বরাজ পার্টির সম্মেলনে ওই সময়ে লিখে কবি গাইলেন ‘ওঠরে চাষী জগৎবাসী ধর কসে লাঙল’ ।
১৯৪৫ খ্রি. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে জগত্তারিনী পদক পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছেন। ১৯৬০ খ্রি. ভারত সরকার পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন রসোত্তীর্ণ কাব্যস্রষ্টা, অসংখ্য গানের রচয়িতা ও সুরকার কবি নজরুল ইসলামকে।
১৯৪১ সালের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এ কবি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসা চলে লুম্বিনী পার্ক ও রাচি মেন্টাল হাসপাতালে। পরে ১৯৫৩ সালে ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে পাঠানো হয় তাকে। এই সময়ে একেবারেই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। ফলে ১৯৫৩ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় নীরবে-নিভৃতেই কাটে তার জীবন।
১৯৭২ সালের ২৪ মে জন্মদিনে ঢাকায় এনে তাকে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবির ‘চল্ চল্ চল্- ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’কে সামরিক সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করে সম্মানিতও করেন।
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি (বর্তমানে বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় এ কবিকে। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।