অবিক রায়
স্বাধীনতার পর থেকেই নারীর ক্ষমতায়ন শক্তিশালী করার উদ্যেগ ছিল প্রতিটি সরকারেই। ফলশ্রুতিতে সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের প্রশংসনীয় সাফল্যেও এসেছে। নারী উন্নয়নের স্বীকৃতি স্বরুপ বাংলাদেশে জাতিসংঘের গৌরাবময় ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ এবং ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেছে।
গ্লোবাল সামিট অব উইমেনের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেছে বাংলাদেশের নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় নারীর অবস্থান কিংবা সম্মান সেভাবে বদলায় নি। এর প্রমান পাওয়া যায় বিগত বছরের বিভিন্ন পরিসংখ্যানে। পুলিশ সদর দপ্তরের ২০১৭ সালে হিসেব অনুয়ায়ী নারী নির্যাতনে মামলা হয়েছে ১৫ হাজার ২১৯ টি।
শুধুমাত্র তাই নয় করোনাভাইরাস এর সংক্রমনে যখন পুরো দেশ গৃহবন্দী ছিলো তখনো হয়েছে নারী নির্যাতন। উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার উদাহরন টানলে যেগুলো উঠে আসে সেগুলো হল, দাম্পত্য কলহকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় স্বামী তার স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে (প্রথম আলো); পারিবারিক কলহের জের ধরে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর মুখে অ্যাসিড ছুড়ে ঝলসে দেন (প্রথম আলো); মাদকাসক্ত স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন শুকলা (২০) নামের এক গৃহবধূ (প্রথম আলো); যৌতুকের দাবিতে ফেনীতে নির্মমভাবে স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা করে স্বামী (ডেইলি স্টার); ঢাকায় নারী আন্দোলন নেত্রী শারীরিক নির্যাতন করে নারী গৃহকর্মীকে (কালের কণ্ঠ); কুষ্টিয়ায় খোকসায় সংখ্যালঘু গৃহবধূর ঘরে ঢুকে ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণ (সমকাল)।
এই সব অমানবিক ঘটনাগুলোর সাথে নরসিংদীতে ঘটে গেলো আরো একটি অমানবিক ঘটনা। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেন থেকে নরসিংদী নামেন এক তরুণীসহ দুই যুবক। তারা ট্রেন থেকে নামার পর স্টেশনেই অবস্থান করছিলেন। তখন এক মহিলা তাদের পোশাক দেখে বাজে ও নোংরা মন্তব্য করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে কয়েকজন মধ্যবয়স্ক ব্যাক্তি ও বখাটে তদের মারধর করতে শুরু করে। তারা মেয়েটির পোশাক ধরে টানাটানি করে। যা স্পষ্টভাবে যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতন। মেয়েরা কী পরবেন, সেটা তারাই ঠিক করবেন। অন্তত একটা আধুনিক, গণতান্ত্রিক দেশে। বিশেষ করে এ দেশে রাস্তাঘাটে মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনা ঘটলেই যেভাবে এক শ্রেণির মানুষ তাদের পোশাককে এ জন্য দায়ী করতে শুরু করেন তা কোনোভাবেই সম্পূর্ন বাস্তবিক নয়। পোষাক কোনো নির্যাতনের কারন হতে পারেনা। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে লিখেছেন, ‘অল্প বয়সী মেয়ে থেকে শুরু করে প্রৌঢ় মহিলা, মা, নানী, দাদী—কেউ রেহাই পাননি। অনেক বুড়ি মহিলা বাড়ি থেকে পালাননি, ভেবেছেন তাদের কিছু হবে না। অল্প বয়সী মেয়েদের সরিয়ে দিয়ে নিজেরা থেকেছেন, তাদেরও ছেড়ে দেয়নি পাকিস্তানি পাষণ্ডরা। এক মহিলা রোগীর কাছে শুনেছিলাম তিনি নামাজ পড়ছিলেন। সেই অবস্থায় তাকে টেনে ধর্ষণ করা হয়। আরেক মহিলা কুরআন শরীফ পড়ছিলেন, শয়তানরা কুরআন শরীফ টান দিয়ে ফেলে তাকে ধর্ষণ করে”।ইসলাম ধর্মে পুরুষের জন্যও পর্দা ফরজ করা হয়েছে। পুরুষ যদি সেই পর্দার বিধানগুলো মেনে চলতো; তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, দেশজুড়ে একের পর এক যৌন নিপীড়ন আর নারী সহিংসতার ঘটনা ঘটতো না।আল কোরআনের সুরা নূরে (আয়াত ৩০) বলা হয়েছে, ‘(হে নবী!) মুমিন পুরুষদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং যৌন পবিত্রতা রক্ষা করে চলে। এটাই তাদের জন্য পবিত্রতম পন্থা। নিশ্চয়ই তারা যাহা কিছুই করে, আল্লাহ তৎ সম্পর্কে পরিজ্ঞাত।’ মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে পুরুষরা যদি আল কোরআনের উপরোক্ত বিধান মেনে দৃষ্টি অবনমিত রেখে চলেন, তাহলে তো তাদের জানার কথা নয়, কোন নারীর বক্ষ উন্মুক্ত অথবা কোন নারী নাভির নিচে শাড়ি পরেছে বা কোন নারীর পোশাক কেমন ইত্যাদি বিষয়।
আমাদের সংবিধানে পোশাকের বিষয়ে কোনো বাধানিষেধ নাই। যার ইচ্ছা হবে হিজাব পরবে, যার ইচ্ছা হবে জিন্স, টি-শার্ট পরবে। তবে কেউ যদি কোনো পোশাকই না পরেন সে ব্যাপারে আইনে বাধা আছে। এটাকে আইন পাবলিক ন্যুইসেন্স হিসেবে দেখে। সেটার জন্য কেউ আইনের আওতায় প্রতিকার পেতে পারেন। বাংলাদেশের সংবিধানেই ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটা কারও উপর এটি চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ ধর্মীয় পোশাক পরতে পারেন আবার কেউ নাও পরতে পারেন। এটা যার যার স্বাধীনতা। ব্যক্তির স্বাধীনতা আছে। প্রাইভেট লাইফের স্বাধীনতা আছে। আছে স্বাধীনভাবে চলাফেরার স্বাধীনতা। এটা কারও পছন্দ বা অপছন্দ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তাছাড়া কোন নারী বা পুরুষের অসম্মতিতে তার দৈহিক গঠন নিয়ে কুটুক্তি বা স্পর্শ করাই যে যৌন হয়রানীর মধ্যে পড়ে এ বিষয়টাই মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নির্দিষ্ট কোন আইন না থাকায়, ২০০৮ সালের ৭ আগষ্ট বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধের দিক নির্দেশনা চেয়ে একটি রিট দায়ের করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ মে-২০০৯ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মাদ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকি; কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সব সরকারি-বেসরকারি, আধা-সরকারি অফিস এবং সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু আদৌ তা বাস্তবায়িত হয়নি।পাশাপাশি উক্ত নীতিমালার ৪ ধারায় যৌন নিপীড়নকে সংজ্ঞায়িত করে আদালত বলেন, শারীরিক ও মানসিক যে কোনো ধরনের নির্যাতন যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। তবে বিভিন্ন আইনে যৌন নিপীড়ন এর বিরুদ্ধে প্রতিকারের বিধান রয়েছে। যদি কোনো ব্যাক্তি যৌন কামনা চরিতার্থ করার জন্য বলপ্রয়োগ করে কিংবা যৌন নিপিড়নমূলক কিংবা অশালীন কোনো আচরণ করে তবে তিনি যৌন নিপিড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। যেমন, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা পেশাগত ক্ষমতা ব্যাবহার করে কেউ যদি কোনো মহিলাকে অনাকাঙ্খিত যৌন আবেদনমূলক আচরণ করে, প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারও সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে, ব্ল্যাকমেইল অথবা চরিত্র লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে স্থির বা চলমান চিত্র ধারণ করে কিংবা প্রেম নিবেদনে করে প্রত্যাখ্যান হয়ে হুমকি দেয় বা চাপ প্রয়োগ করে কিংবা ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতারনার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনে চেষ্টা করে তবে সেগুলো যৌন নিপিড়নের আওতায় পড়বে। বাংলাদেশ দন্ডবিধি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা-১০, ৯ক এ যৌন পীড়নের শাস্তি এবং বাংলাদেশ সংবিধানের ৩২ ও ৩৬ অনুচ্ছেদে এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ৩৪ অনুচ্ছেদে এ সর্ম্পকে স্পষ্ট বলা আছে।
নরসিংদীর রেল স্টেষনে এক তরুনীকে নির্যাতনের গঠনায় আমাদের বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৫৪ ধারা খুব সুন্দরভাবে মিলে যায়। এই ধারা অনুসারে কোন ব্যক্তি নারীর শালীনতা নষ্ট করার অভিপ্রায়ে বা তার শালীনতা নষ্ট হতে পারে জেনে-শুনে কোন নারীকে আক্রমন করে বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে বা জাপটে ধরে বা স্পর্শকাতর অঙ্গ সমূহে স্পর্শ করে বা ব্যক্তিগত মর্যাদার হানি ঘটায় তাহলে ওই ব্যক্তি ৩৫৪ ধারার অপরাধে অভিযুক্ত হবে। এ অপরাধের শাস্তি দু’ বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয়বিধ দণ্ড। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ৩২ ও ৩৬ অনুচ্ছেদ- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না’। এই অনুসারে দুজন নারীকে যেভাবে জনসম্মুখে নির্যাতন করা হয়েছে তা স্পষ্টভাবে সংবিধান পরিপন্থী।
২০১৮ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, গণপরিবহণে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আরো হয়রানির আশঙ্কায় নারীরা প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। যৌন নিপীড়ন বন্ধে সরকারি নানবিধ উদ্যোগ থাকলেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখছে না।ব্র্যাকের জরিপের তথ্যানুসারে, হেনস্থাকারীদের অধিকাংশই মধ্যবয়সী বা বয়স্ক পুরুষ (৪১ থেকে ৬০ বছর)।
ঘরে–বাইরে সর্বত্র নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না এ ব্যাধির হাত থেকে। নারীদের অবাধ বিচরণ হলেও তারা বিভিন্ন স্থানে যেমনঃ– বাড়ি, রাস্তাঘাট, যানবাহন, ফুটপাত কিংবা জনসমাগম হয় এমন স্থানগুলোতে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নারী সহিংসতা রোধে আছে আইন, বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সনদ ও চুক্তি। কিন্তু এগুলোর কোনো বাস্তবায়ন নেই।শুধুমাত্র আইন নয় নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারবে। যার মাধ্যমে নারী পাবে সহিংসতার প্রতিকার। গড়ে উঠবে সহিংসতামুক্ত একটি সুন্দর সমাজ। তাই নারীদের প্রতি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে পরিবার ও সমাজ তথা আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সহযোগী আইন কর্মকর্তা, বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা।