৪৮৬ টন ‘বিপজ্জনক রাসায়নিকে’ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম বন্দর

চট্টগ্রাম ব্যুরো: এক বছর আগে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের সাক্ষী হয়েছিল লেবাননের বৈরুতের বন্দর। ওই সময় থেকেই বিপর্যয় এড়াতে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে উচ্চমাত্রার দাহ্য ও বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ খালাস বন্ধ এবং বন্দরের বিভিন্ন শেডে পড়ে থাকা রাসায়নিক সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, সেই উদ্যোগে তেমন গতি আসেনি। বন্দরের বিভিন্ন শেডে এখনো পড়ে আছে ৪৮৬ মেট্রিক টন বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ।

এসব রাসায়নিক শেডে থাকার কারণে ‘উচ্চ নিরাপত্তা ঝুঁকি’ তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ কয়েক দফা কাস্টমসকে সেগুলো নিলামে তোলা অথবা ধ্বংস করার উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু বন্দর ও কাস্টমসের রশি টানাটানিতে বিপজ্জনক রাসায়নিকে এখনো সয়লাব চট্টগ্রাম বন্দরের শেড। চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা এজন্য কাস্টমসের ধীরগতিকে দায়ী করেছেন। অন্যদিক কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেছেন, খালাস না নেওয়া আমদানি পণ্য নিলাম বা ধ্বংস করা একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

২০২০ সালের ৪ আগস্ট লেবাননের রাজধানী শহর বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণে কমপক্ষে ১০০ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ। লেবাননে বিস্ফোরণের পর গত বছরের ১০ আগস্ট বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শকের কার্যালয় থেকে দেশের সব সমুদ্র, বিমান ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে অননুমোদিত স্থানে বিস্ফোরক, প্রথম শ্রেণির পেট্রোলিয়াম, প্রজ্জ্বলনীয় তরল ও কঠিন পদার্থ ও রাসায়নিক মজুত না করার অনুরোধ করে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে যেসব পদার্থের বিষয়ে সতর্ক করা হয় সেগুলো হচ্ছে— ইমালশান সিসমিক, পাওয়ারজেল সিসিমিক, সিসিমিক ডেটোনেটর, চার্জেস ডেটোনেটর, ইলেকট্রিক ডেটোনেটর ও টিএনটি এবং অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, সোডিয়াম নাইট্রেট, সালফার, পটাশিয়াম ক্লোরেট এবং ফসফরাসসহ ২১ ধরনের প্রথম শ্রেণির পেট্রোলিয়াম, প্রজ্বলনীয় তরল ও কঠিন পদার্থ।

বিস্ফোরক পরিদফতরের চিঠি পাওয়ার পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমোডোর শফিউল বারীকে প্রধান করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। সূত্র মতে, কমিটি বিস্ফোরণজনিত বিপর্যয় এড়াতে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে উচ্চমাত্রার দাহ্য ও বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ কনটেইনার থেকে খালাস বন্ধের সুপারিশ করে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের শেডে খালাসের অপেক্ষায় থাকা দাহ্য ও বিস্ফোরক পদার্থ বা রাসায়নিক আছে— তার তালিকা করে সেগুলো দ্রুত খালাস অথবা ধ্বংসের সুপারিশ করে কমিটি।

তবে কমিটির সুপারিশের পরও গত এক বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে উচ্চমাত্রার দাহ্য ও বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ কনটেইনার থেকে খালাস পুরোপুরি বন্ধ হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেমিকেল তো আমদানি করতে হবে। আমদানি করা কেমিকেল খালাসও করতে হবে। সেটি তো আর একেবারে বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। তবে সিস্টেমটা উন্নত করেছি। ঝুঁকি এড়াতে যা যা করা দরকার, সেগুলো করছি। খালাসের পর দ্রুত বন্দরের শেড থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। এখন যেসব রাসায়নিক বন্দরের অভ্যন্তরে আছে সেগুলো আগে আমদানি করা পণ্য, গত একবছরে আমদানি হয়েছে এমন পণ্য নেই।’

প্রসঙ্গত, আমদানি করা পণ্য বন্দরের ইয়ার্ড থেকে ৩০ দিনের মধ্যে খালাস না নিলে শুল্ক বিভাগে হস্তান্তর করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর পণ্য খালাস না নিলে আমদানিকারককে নোটিশ দেয় কাস্টমস। নোটিশের ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য খালাস না করলে কাস্টম কর্তৃপক্ষ সেসব নিলামে তুলতে পারে। আবার কেউ মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য এনে জব্দ হলে সেগুলোও নিলামে তোলার বিধান আছে। নিলামে সেই পণ্য কেউ না কিনলে ধ্বংস করার বিধান আছে।

চলতি বছরের ৩১ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টমসকে দেওয়া এক চিঠিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেছে, প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন পণ্যভর্তি সাত হাজার কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে পড়ে আছে, যেগুলো নিলাম অথবা ধ্বংসযোগ্য। এর মধ্যে বন্দরের পি-শেডে আছে ৪৮৬ মেট্রিক টন রাসায়নিক ও বিপজ্জনক মালামাল। আবার এর মধ্যে দীর্ঘ দিনের পুরনো নিলাম ও ধ্বংসযোগ্য মালামাল আছে ৯৩ মেট্রিক টন, যা বন্দরে উচ্চমাত্রার নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে।

নিলাম বা ধ্বংসযোগ্য অন্যান্য পণ্যের মধ্যে আছে— ৭২০ মেট্রিক টন ওজনের ৩৬০টি গাড়ি, ২০ ফুটের ২ হাজার ১৭৪ টিইইউস কনটেইনারে ৩৪ হাজার ৭৮৪ মেট্রিক টন এবং ৪০ ফুটের ২ হাজার ৫৪৫ কনটেইনারে ৫০ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন পণ্য। এছাড়া ৪ হাজার ৭১৯ মেট্রিক টন এলসিএল কার্গো এবং ৬ হাজার ৫২৭ মেট্রিক টন বাল্ক কার্গো পণ্য আছে, যেগুলো আমদানিকারকরা ছাড় করেননি।

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির পর দেশীয় বাজারে দরপতন, চাহিদা কমে যাওয়াসহ নানা অজুহাতে এসব পণ্য আর খালাস করেন না আমদানিকারকরা। ফলে বছরের পর বছর ধরে সেগুলো বন্দরের শেডে পড়ে থাকে। মূলত বন্দরের শেডকেই গুদাম হিসেবে ব্যবহার করেন একশ্রেণির আমদানিকারক। এর মধ্যে অনেক পণ্য আবার পচনশীল। খালাসের অপেক্ষায় পড়ে থাকা কনটেইনারভর্তি মালামাল, গাড়ি ও বাল্ক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত কাস্টমসকে ১৬ দফা চিঠি দিয়েও ইয়ার্ডে ও শেডে থাকা এসব পণ্য নিলাম বা ধ্বংস করাতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় সবশেষ চট্টগ্রাম বন্দরের চিঠিতে বলা হয়েছে, যথাসময়ে পণ্য ছাড় না করায় এখন বন্দরের অভ্যন্তরে কার্গো-কনটেইনার সংরক্ষণের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। এ অবস্থায় বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।

তবে পি-শেডে থাকা ৪৮৬ মেট্রিক টন রাসায়নিক ও বিপজ্জনক মালামালই এখন চট্টগ্রাম বন্দরের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করায় এসব মালামাল দ্রুত নিলাম অথবা ধ্বংস কিংবা প্রযোজ্য যেকোনো উপায়ে নিষ্পত্তি করার জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছে বন্দর।

বিস্ফোরক পরিদফতরের বিধিমালার আওতায় যেসব রাসায়নিক আমদানি হয় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— ক্যালসিয়াম কার্বাইড, পটাসিয়াম ক্লোরেট, রেড ফসফরাস, সালফার, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, পটাশিয়াম নাইট্রেট, সোডিয়াম নাইট্রেট, নাইট্রো সেলুলোজ। আলাদা বিধিমালার আওতায় আমদানি হয় বিস্ফোরক তৈরির উপাদান অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। বিস্ফোরক পরিদফতরের কর্মকর্তাদের মতে, এটি সার হিসেবে, খনিতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ফুয়েল বিস্ফোরক তৈরিতে এবং মেডিকেলে নাইট্রাস অক্সাইড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড এবং বেসরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠানের এই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট আমদানির লাইসেন্স আছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘রাসায়নিকগুলো দীর্ঘদিন বন্দরের অভ্যন্তরে পড়ে থাকায় উচ্চ নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করেছে— এটি সত্যি। কিন্তু আমদানি পণ্য, বিশেষ করে রাসায়নিক নিলামে তোলা বা ধ্বংস করার একটি প্রক্রিয়া আছে। এর সঙ্গে শুধু বন্দর বা কাস্টমস নয়, আরও আটটি সরকারি সংস্থা যুক্ত। অনেক সময় নিলামে তোলার পর সেসব পণ্য নিতে কেউ আগ্রহী হন না। তখন ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। এতে সময় লাগে। তবে আমরা চাই, বন্দরটা নিরাপদ থাকুক। দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেন খালাস না নেওয়া পণ্য ডিসপোজাল হয়।’

তবে চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার (নিলাম) মোহাম্মদ আল আমিনের দাবি, নিয়মমাফিকভাবেই নিয়মিত বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় পড়ে থাকা পণ্য নিলামে তোলা হয় অথবা ধ্বংস করা হয়। এক্ষেত্রে কোনো গাফিলতি করা হয় না। লেবাননে বিস্ফোরণের পর দ্রুততার সঙ্গে প্রথম দফায় ৪৯ মেট্রিক টন ও পরবর্তী সময়ে আরও ৯ মেট্রিকটন রাসায়নিক মালামাল ধ্বংস করা হয়েছে। কাস্টমসের নিলাম কমিটি সম্প্রতি আরও আট মেট্রিক টন রাসায়নিক সুনামগঞ্জের ছাতকে লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট কারখানায় নিয়ে খালাসের উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া ১১৯টি গাড়ি নিলামে তোলার একটি প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে।

কাস্টমস কর্মকর্তা আল আমিন বলেন, ‘আমরা নিয়মিতই বন্দরের ইয়ার্ডে থাকা নিলামযোগ্য পণ্য নিলামে তুলছি। যেগুলো ধ্বংসযোগ্য, সেগুলো নিয়ম মেনে ধ্বংসও করছি। প্রতিমাসেই এটি হচ্ছে। এক্ষেত্রে গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই।’

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.