বেঁচে থাকাই যেখানে বিলাসিতা!

‘তৃপ্তির ঢেকুর তোলা যেখানে বিলাসিতা’— এই উক্তিটি কমবেশি সবাই জানে। দফায় দফায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এসবের মধ্যে খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রংপুরের মোহাম্মদ এনামুল (৩৮)। আগে দিনমজুরের কাজ করতেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় রুজি কম হওয়ায় ভালোভাবে বাঁচার আশায় চলে আসেন চট্টগ্রামে। থাকেন চট্টগ্রামের ফয়’স লেক এলাকায়। ৯ বছর ধরে তিনি রিকশা চালিয়ে পরিবার চালাচ্ছেন মোটামুটি ভালোই। প্রতিদিন খাবার ও রিকশাভাড়া ১শ’ টাকা দিয়ে আরও ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা থাকতো। কিন্তু কে জানতো ভালো আয়ের আশায় শহরে আসা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দফায় দফায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি একদিকে যেমন তাঁর নিত্যদিনের আয় রোজগারে প্রভাব ফেলছে অন্যদিকে নতুন করে আবার যুক্ত হল বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে রাত ৮টার পর দোকানপাট বন্ধ। যা এখন এনামুলের জন্য বাড়তি একটা শঙ্কার বিষয়।

এনামুল বলেন, ‘যা ইনকাম হয় তা দিয়ে ঘরের বাজারের চাহিদা মেটাতে পারি না। সব জিনিসের দাম বাড়ছে। আবার রাত ৮টার পর যাত্রী মিলে না। যাত্রী নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গেলে সেখান থেকে যাত্রী না পেয়ে খালি আসতে হয়। কারণ, এখন রাত ৮টার পর দোকান বন্ধ থাকায় কেউ বাইরে বের হয় না। যার কারণে আমাদের ভাড়া কমছে। আর আয়ও কমেছে।’

তাছাড়া টিসিবির লাইনে দাঁড়ানোর সামর্থ্যও নেই জানিয়ে এনামুল বলেন, ‘আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষদের আসলে টিসিবির লাইনে দাঁড়ানোর সামর্থ্যও নেই। কারণ এত যে লাইন; তারমধ্যে সেই টিসিবিও তো বিনা পয়সায় পণ্য দেয় না। ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি করে। কিন্তু ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতেও তো টাকা লাগে।’

রিকশাচালক আলী হোসেন (৪৫)। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা হলেও পরিবার নিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম নগরের ঝাউতলা বাজারের একটি ভাড়া বাসায়। সারাদিন রিকশা চালিয়ে যা আয় হয়; তা দিয়েই পরিবারের সদস্যদের মুখে অন্ন তুলে দেন। বিলাসিতার কথা তার ভাবাও পাপ! তার কথা শুধু কোনো রকম খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা। আর এ বেঁচে থাকাটাই এখন সবচেয়ে বড় দায় জানিয়ে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘গত ৬ বছর ধরে আমি চট্টগ্রামে রিকশা চালাই। যা ভাড়া জুটতো তা দিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো চলতাম। মাঝে করোনার কারণে অনেকদিন সমস্যায় ছিলাম। তারপরও কোনো রকম চলতো। কিন্তু দিন দিন জিনিসের দাম বাড়ছে। মাসের প্রতিটি দিন রিকশা চালিয়ে মাস শেষে হিসেবে যোগ হয় মাত্র ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু এ টাকা দিয়ে সংসার চলে না। এরমধ্যে আয়-রোজগার কমছেও বলে জানান তিনি।

‘পয়সা নাই যার, মরণ ভালো’ —গানের এ লাইনের সঙ্গে বাস্তবতা ফুটে উঠেছে জনজীবনে। করোনার কারণে গত দু’বছর ধরে এমনিতেই খেঁটে খাওয়া মানুষের আয় রোজগার কমেছে। অন্যদিকে বারবার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের এ সীমিত আয়ে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। এদিকে নতুন করে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে রাত ৮টার পর দোকানপাট বন্ধ এসব খেটে খাওয়া মানুষদের ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাত ৮ টার পর জনসমাগমের স্থানগুলোও এখন নিরব থাকায় ব্যস্ত নগরের চিরপরিচিত কোলাহল থেমে যায় রাত ৮টার পর। এতে অনেকটাই ঘরবন্দি হয়ে রাস্তায় আনাগোনা কমেছে মানুষের। এর সবচেয়ে খারপ প্রভাবটুকু পড়ছে রিকশাচালক থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষদের ওপর। কোনো রকম খেয়ে বেঁচে থাকা যাদের দায়; তাদের বিলাসিতার কথা ভাবাও পাপ!

শুক্রবার ও শনিবার রাতে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, মোড়ে মোড়ে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চালকরা। রিকশার তুলনায় যাত্রী অনেক কম। ফলে কোনো যাত্রী দেখলেই ঘিরে ধরছেন চালকরা। হামজারবাগ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন গফুর আলী। এই রিকশাচালক বলেন, ‘রাত ৮টার পর তো মার্কেট বন্ধ। আগের মতো আয় নেই। আগে যেখানে সারাদিন যাত্রী না মিললেও সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত ভালো আয় হতো। এখনও সেটা হয় না। এছাড়া দিন দিন জিনিসপত্রের যেভাবে দাম বাড়ছে সেভাবে ভালো আয় করে পুষিয়ে নেওয়াটাও দায় হয়ে গেছে।

মুরাদপুর এলাকায় ইলেকট্রনিক জিনিস নিয়ে বসা ভাসমান দোকানি শাহাদাত আলী বলেন, ‘আমার পাঁচ সদস্যের পরিবার। সারাদিন বসে থাকলেও রাত ৮টার পর চলে যেতে হয়। কারণ, তখন আর মানুষ থাকে না। সারাদিন বেচাকেনা করে মাত্র ৭-৮শ’ টাকা হয়। যা আয় হয়; তা দিয়ে খরচ চালানো যায় না। কারণ, জিনিসের দাম বাদ দিয়ে সারাদিনে লাভ থাকে মাত্র ২শ’ টাকা। এ টাকা দিয়ে তো আর চলা যায় না। সকল জিনিসের দাম বাড়ছে; কম দামে তো কিছুই পাওয়া যায় না। আসলে গরিম মানুষের মরণই ভালো।’

তারই পাশে পাশে ভাসমান দোকানে জুতা, স্যান্ডেল বিক্রি করছেন রফিক (৩৮)। পড়ালেখা করেছেন এসএসসি পর্যন্ত। পরিবারের দায়িত্ব ঘাড়ে পড়ায় নামতে হয়েছে জীবনযুদ্ধে। ভর্তি হতে পারেননি আর কলেজে। তাই গ্রামের বাড়ি রংপুর ছেড়ে এসেছেন চট্টগ্রাম শহরে। পরে পরিচিত এক ভাইয়ের সাহায্যে নামেন জুতা-স্যান্ডেল বিক্রির কাজে।

‘দিনকাল কেমন কাটছে’ এ কথা জিজ্ঞেস করতেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘সারাজীবনই দুঃখকষ্টে কেটেছে। ছোটকাল থেকে পরিবারের দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর। প্রথম প্রথম ভালোই বেচাবিক্রি হয়েছে। কিন্ত এখন কাস্টমার কমে গেছে। মূলত আমাদের বেচাবিক্রি বাড়ে সন্ধ্যার পর থেকে। কিন্তু বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে রাত ৮টার পর দোকান বন্ধ থাকায় এ অল্প সময়ে খুব কমই বেচাকেনা হয়। আবার এ অল্প রোজগার নিয়ে বাড়িতেও ভালো টাকা পাঠাতে পারি না। তাদেরও অল্প টাকায় হয় না। বর্তমানে সবকিছুরই দাম বাড়তি। আগে কখনও এমন সংকটে পড়িনি। তেল থেকে শুরু করে আলুর দামও এখন বাড়তি। অল্পতে খেয়ে বেঁচে থাকার মতো কিছু নেই বললেই চলে।’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এখন অনেক বেড়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষ ঘরভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। তার উপর গ্যাস, বিদ্যুৎ পানির বিল তো আছেই। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ ওই মোতাবেক পরিকল্পনা নিয়ে থাকেন। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় যদি হঠাৎ করে আরও বেড়ে যায় তখন মানুষ বিপাকে পড়ে যান। মাছ-মাংস, তেল, সবজি কোন কিছুতেই শান্তি নেই। সাধারণ মানুষ দু’বেলা দুমুঠো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে চায়। সেখানেও হোঁচট খাচ্ছেন তারা।’

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.