দয়াল কুমার বড়ুয়া
বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে দেশি ও বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এর মধ্যে রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে। এ সংকট দ্রুত শক্তভাবে প্রতিহত করতে না পারলে দেশের পুরো পোশাকশিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। শ্রমিকদের উত্তেজিত করে গার্মেন্ট খাতকে অচল ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারকে বিপাকে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে একটি কুচক্রী মহল। বেশিরভাগ গার্মেন্ট কারখানা সচল থাকলেও কিছু কারখানার শ্রমিক বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করা থেকেই বোঝা যায়, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলনে কোনো বাধা নেই। তারা মানববন্ধন কিংবা সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি উত্থাপন ও তা আদায় করতে পারে। তবে সন্ত্রাসী কায়দায় সড়ক অবরোধ, কারখানা ও যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণ কি? দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করবে কেন? তারা কেন সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে? কেন ত্রাসের পথ বেছে নিতে হবে?
বর্তমানে শিল্প খাতে যে অস্থিরতা চলছে। দ্রুততম সময়ে এটি কমানো না গেলে শিগগির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ রফতানি আয়ের প্রায় ৮৩ ভাগ গার্মেন্ট খাত থেকে আসে। শ্রমিক আন্দোলনের নামে গার্মেন্ট খাতে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারিদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে। আন্দোলনের নামে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, জনজীবন বিপর্যস্ত ও অচল করে দেয়া এবং অর্থনীতির ক্ষতি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এর পেছনে যারা রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো শিল্প খাত। এক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। এ খাত শুধু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারকেই সমৃদ্ধ করেনি, একইসঙ্গে নিশ্চিত করেছে অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান। পোশাক শিল্পের হাত ধরেই দেশের অর্থনীতিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে সামনের সারিতে বাংলাদেশ। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে পোশাক শিল্প। দেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের ক্ষমতা বাড়িয়েছে এ খাত।
বর্তমানে বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। সারা পৃথিবীতে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাতি দিয়েছে এই পণ্য। শ্রমঘন এ শিল্পটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। এ খাতের হাত ধরেই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিকাশ হয়েছে। গার্মেন্টস দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও পরে তারা অন্যান্য শিল্পে রূপান্তর ঘটিয়েছে। আর বর্তমানে রাজস্ব আয়ের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই আসছে বেসরকারি খাত থেকে। অন্যদিকে পোশাক শিল্পের বিকাশে নারীর ক্ষমতায়নসহ বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ছাড়াও তৈরি পোশাক শিল্পে ২৫ লাখের বেশি নারী শ্রমিক কাজ করছেন। এতে শ্রমজীবী নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পরিবারে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের কারণে এসব নারীর সামাজিক মর্যাদাও বেড়েছে। চাকরির সুবাদে পুরুষের কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে।
স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরে পোশাক শিল্প দেশকে অনেক দিয়েছে। কর্মসংস্থান ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে বিশাল অবদান এ খাতের। আজকের যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, তার পেছনে পোশাক শিল্পের অবদান অন্যতম। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিরূপ অবস্থার মধ্যেও টিকে থাকার জন্য যে দুটি খাতকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় তার একটি হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প।
জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প স্থাপন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্প একধাপ এগিয়ে। সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। রফতানি বাণিজ্যেও তৈরি পোশাক শিল্পের আছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বেকার সমস্যা সমাধান, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই শিল্প। এ শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পেয়েছে নতুন পরিচিতি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এই খাত। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেজিং ইত্যাদি শিল্পেরও ঘটেছে সম্প্রসারণ। এর বাইরেও পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্স্যুরেন্স সেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমান বাংলাদেশে বস্ত্র শিল্প সংশ্লিষ্ট তৈরি পোশাক শিল্পের বিরাট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় গার্মেন্ট শিল্পের প্রসারের পথে বিরাজমান যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করে এ শিল্পের উত্তরণে এগিয়ে আসা সংশ্লিষ্ট সকলের অন্যতম দায়িত্ব। আর এ লক্ষ্যে সঠিক পরিকল্পনা ও সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলেই এখানে ১০০% সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।
তৈরি পোশাকশিল্প কঠিন সময় অতিক্রম করছে। শ্রমিক অসন্তোষের জেরে একদিকে কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশি ক্রেতারা শীত ও গ্রীষ্মের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। রপ্তানি আদেশ যাতে অন্য দেশে চলে যায়, সেজন্য পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্টে হামলা, ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভ করা হচ্ছে। তাই, রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মালিকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিকনেতা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও চবি অ্যালামনাই বসুন্ধরার সভাপতি। সাবেক ট্রাস্টি, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট।