হালদায় ডিম সংগ্রহে ব্যস্ত সংশ্লিষ্টরা

টানা দুই দিন নমুনা ডিম ছাড়লেও হালদাতে পুরোদমে এবার ডিম ছাড়েনি মা মাছ। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে এশিয়ার একমাত্র মিঠাপানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর পানি লবণাক্ত হওয়ায় এবং বৃষ্টি না থাকায় আশানুরূপ ডিম ছাড়েনি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত বছর ২৫ হাজার কেজির বেশি ডিম সংগ্রহ করা হলেও এবার সেখানে ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৫শ কেজির একটু বেশি। যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং গত বছরের চেয়ে অন্তত চারগুণ কম। অথচ নৌকা, ডিম সংগ্রহকারী ও হ্যাচারীর পরিমাণ এবার বাড়তি ছিল। হালদার মা মাছ রক্ষায় অন্য বারের চেয়ে বেশি তৎপর ছিল প্রশাসনও। এরপরও বৈরী আবহাওয়ার কারণে হতাশ হতে হয়েছে সকলকে।

এবার সরকারিভাবে গঠিত ‘হালদা নদীর ডিম ও রেণু গণনা কমিটি’ সংগ্রহিত ডিমের পরিমাণ নির্ণয় করে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। স্থানীয়ভাবে প্রকাশ না করে তা মৎস মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী। তাই এ বিষয়ে সরকারি কোনও কর্মকর্তাই মুখ খুলছেন না। যদিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির একদল ছাত্রের মাধ্যমে ডিম সংগ্রহের পরিমাণ জরিপ করা হয়। ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া সিভয়েসকে বলেন, ‘আমাদের ছাত্ররা এবার ডিম সংগ্রহ নিয়ে কাজ করেছিল। তাদের হিসেবে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কেজির একটু বেশি ডিম সংগ্রহ হয়েছে।’

গতবারের থেকে প্রায় চারগুণ কম ডিম সংগ্রহের কারণ হিসেবে এ হালদা গবেষক বলছেন, এবার দূষণ ও চোরা শিকার বন্ধে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে ডিমের পরিমাণ বাড়বে বলে আশা ছিল। কিন্তু প্রকৃতির বৈলীতার কারণে আমাদের আশা পূরণ হয়নি। প্রথমত সেভাবে বৃষ্টি হয়নি। দ্বিতীয়ত, হালদার পানিতে মাত্রারিক্ত লবণ পানি। আমার দেখা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ লবণাক্ত পানি আমরা হালদা নদীতে পেয়েছি। গতকাল পানি পরীক্ষায় হালদায় স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ গুণ বেশি লবণাক্ততার পরিমাণ আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ না কমলে মা-মাছের ডিম ছাড়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। আমি মনে করি এই লবণাক্ততা যদি কেটে যায়, মা মাছ পূর্ণাঙ্গ ডিম ছাড়বে।’

ডিম সংগ্রহকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার রাত পৌণে ১২টায় একবার, গত বুধবার দুপুর ১২টার পর এবং রাত ১০টার পর তিন দফায় মা মাছ নমুনা ডিম ছাড়ে।

হালদা বিশেষজ্ঞদের মতে, নমুনা ডিম হচ্ছে, মা মাছগুলো তার একটু যদি অনুকূল পরিবেশ পায়, একটু করে ডিম ছেড়ে অনুকুল পরিবেশ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে পূর্ণাঙ্গ ডিম ছাড়ে। মঙ্গলবার ও বুধবার দুপুরে ও রাতে নমুনা ডিম ছেড়েছে।

মঙ্গলবার রাত পৌণে ১২টার, বুধবার দুপুর ১২টার পর ও রাত ১০টার পর তৃতীয় দফায় হালদা নদীর হাটহাজারী ও রাউজান অংশের আজিমের ঘাট, অংকুরি ঘোনা, কাগতিয়ার মুখ, গড়দুয়ারা নয়াহাট, রাম দাশ মুন্সির ঘাট, মাছুয়া ঘোনাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েক শতাধিক নৌকা ও ডিম সংগহের সরঞ্জাম নিয়ে নমুনা ডিম আহরণ করেন শত শত ডিম সংগ্রহকারী।

প্রবীণ ডিম সংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন সওদাগর বলেন, বুধবার রাত ১০টায় প্রতি নৌকা আধা কেজি বা তার চেয়ে কম ডিম আহরণ করতে পেরেছেন ডিম সংগ্রহকারীরা।

মো. জামসেদ বলেন, রাত ১০টায় ডিম পাওয়ায় বৃহস্পতিবার ডিম সংগ্রহের সরঞ্জাম নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন তারা। রাতে ডিম পাওয়া গেলেও বৃহস্পতিবার দিনের বেলায় কারো জালে ডিম ধরা পড়েনি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সংগ্রহীত ডিম থেকে রেণু ফোটানোর জন্য দুই উপজেলার ৪টি সরকারি হ্যাচারি, আইডিএফের একটি হ্যাচারি ও ১৪৫টি মাটির খোয়া প্রস্তুত রাখে প্রশাসন ও ডিম সংগ্রহকারীরা।

বুধবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে জোয়ারের বর্ধিত পানি নদীর পাড় ডিঙ্গিয়ে নদীপাড়ের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট পানির নিচে তলিয়ে যায়। এছাড়া ডিম ফোটানোর জন্য তৈরি করা মাটির কুয়ায় পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে।

হালদা থেকে গত বছর ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে ৭ হাজার কেজি, এর আগে ২০১৮ সালে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালে ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে শুধুমাত্র ৭৩৫ কেজি  নমুনা ডিম সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।

কিন্তু এ বছর মে মাস শেষ হতে চললেও ডিম না ছাড়ায় কিছুটা হতাশ সংশ্লিষ্টরা। গড়দুয়ারা নয়াহাট এলাকার ডিম সংগ্রহকারী ওসমান মাঝি বলেন, ‘আমরা গত চার দিন ধরে রাত দিন নদীতে পরে আছি এই ঝড়-বৃষ্টিতে। পরপর দু’দিন নমুনা ডিম দিলেও পুরোদমে ডিম ছাড়েনি। মা মাছ ডিম ছাড়ার সাহস পাচ্ছে না নদীর এ পরিস্থিতিতে। কেননা, একতো বৃষ্টি হচ্ছে না দ্বিতীয়ত পানি বেশি লবণাক্ত হয়ে গেছে। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া করার কিছু নেই।’

এদিকে নদীর লবণাক্ত কেটে যাবে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয় এবং উত্তাল সাগর শান্ত হলে লবণাক্ততা হ্রাস পাবে। আমার আশাবাদি আমাগী দুই একদিনের মধ্যে ভালো ফলাফল পাবো।’

জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলা মৎস কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজমুল হুদা রনি বলেন, ‘বৈরী পরিবেশের কারণেই পুরোদমে ডিম ছাড়েনি মা মাছ। অতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার কারণে এমনটিই হয়েছে। যা ডিম ছেড়েছে তা ঠিকমত সংগ্রহ করতে পারেননি জেলেরা। ডিমগুলোর বেশিরভাগ খালে বিলে চলে গেছে। সেখানকার গাছের পাতায় খড়ে অনেকে ডিম লেগে থাকার খবর দিচ্ছে।’

প্রথম জোতে আশাহত হলেও দু’দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আশানুরূপ ডিম পাওয়া যাবে বলে জানান এ মৎস কর্মকর্তা।

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.