সৈয়দ আককাস উদদীন, সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার ভরসার একমাত্র জায়গা সরকারি হাসপাতাল। সামান্য টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগই মূলত সাধারণ মানুষকে এসব হাসপাতালে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ওই হাসপাতালের বহির্বিভাগে টিকেট বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তিন টাকার টিকিট ভাঙতি না থাকার অজুহাতে রোগীদের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে আদায় করা হচ্ছে পাঁচ টাকা। রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। দীর্ঘদিন ধরে এ অনিয়ম চললেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বর্তমানেও এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।
এ ছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে এক থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। জরুরী বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা সেখানে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীর মাধ্যমে এই অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছেন বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে রোগীদের কাউন্টার থেকে টিকিট নিতে হচ্ছে। রোগীরা দীর্ঘ লাইন ধরে কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করছেন। টিকেট কাউন্টারে ইমতিয়াজ এবং হারাধন নামে দুই ব্যক্তি রোগীদের টিকিট দিচ্ছেন। তারা প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে তিন টাকা মূল্যের টিকেট পাঁচ টাকা করে আদায় করছেন।
আরো পড়ুন
এ হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী সেবা নেন। এর মানে দাঁড়াচ্ছে প্রতিদিন রোগীদের কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে। মাস শেষে এ অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ৩০ থেকে ৩৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লক্ষ টাকা রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে টিকেট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা ইমতিয়াজ ও হারাধন বলেন, ভাঙতি না থাকায় রোগীদের কাছ থেকে পাঁচ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সাথে আলাপ করতে বলেন তারা।
বাজালিয়া ইউনিয়নের বড়দুয়ারা গ্রাম থেকে স্বামী জালাল আহমদকে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন স্ত্রী রওশন আক্তার। তিনি বলেন, আমি দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিটের জন্য কাউন্টারে একটি দশ টাকার নোট দিয়েছি। তারা আমাকে একটি টিকেট দিয়েছে সাথে পাঁচ টাকা ফেরত দিয়েছে।
হাসপাতালের বহির্বিভাগে কথা হয় পদুয়া ইউনিয়নের বৃদ্ধ সরোয়ার কামাল, মাদার্শা ইউনিয়নের বুলু আক্তার ও ঢেমশা ইউনিয়নের হাবিবা আক্তারের সঙ্গে। তারা প্রত্যেকে জানান, তারা প্রায় সময় এ হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আসেন। টিকেটের মূল্য কত টাকা সেটা তারা জানেন না। তবে তাদের কাছ থেকে প্রতিটি টিকেটের মূল্য পাঁচ টাকা করে নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মচারী খবরের কাগজকে বলেন, কাউকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতাল আনা হলে তাদের স্বজন থেকে এক থেকে দুই হাজার টাকা নেওয়া হয়। জরুরী বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ সেখানে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীর মাধ্যমে এই অতিরিক্ত টাকা আদায় করে থাকেন। বর্তমানে এটি এক প্রকার রীতিনীতিতে পরিণত হয়েছে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, মানুষ সরকারি হাসপাতাল বেছে নেয় কম খরচের কারণে। অথচ শুরুতেই যখন বাড়তি টাকা গুনতে হয়, তখন সেই আস্থার জায়গাটি নষ্ট হয়। তিন টাকার টিকিট পাঁচ টাকা নেওয়া মানে শুধু অনিয়ম নয়, বরং সাধারণ মানুষের প্রতি প্রতারণা। এভাবে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা জনগণের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এই অনিয়মের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ভাঙতি না থাকার কারণে বহির্বিভাগে টিকেটের মূল্য পাঁচ টাকা নেওয়া হচ্ছে। যারা ভাঙতি দিচ্ছেন তাদের কাছ থেকে তিন টাকাই রাখা হচ্ছে। আর জরুরি বিভাগে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রোগীদের কাছ থেকে তিন টাকার বেশি আদায় না করার জন্য প্রত্যেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তাদের বলে দেওয়া আছে। ভাঙতি টাকা না থাকার অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কোনো সুযোগ নেই। হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট যেকোনো অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।