চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ পরিবহনশ্রমিকরা

পরিদর্শক পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা তিনি। কাজ করেন চট্টগ্রাম নগরের ট্রাফিক বিভাগে। মাসে মাসে চাঁদা না দিলে তার আওতাধীন সড়কে গাড়ি চলাচলে বাধাদান, ঠুনকো বিষয়ে গাড়িচালক-হেলপারদের গায়ে হাত তোলা ও গাড়ির কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে হয়রানি করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ জমা পড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সর্বশেষ গতকাল (শনিবার) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে শ্রমিকদের এক মানববন্ধনে তার বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি করেন পরিবহন নেতারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার নাম সুমন জাহিদ লোভেল। তিনি পাঁচলাইশ থানার পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন) হিসেবে কর্মরত। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। চট্টগ্রাম নগর পুলিশে তিনি প্রায় তিন বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত বলে জানা গেছে। অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান, ট্যাংকলরি ও প্রাইমমুভার মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ।

অভিযোগ পেয়েই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বিষয়টি পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপিকে খতিয়ে দেখার নির্দেশনা দেন। পুলিশ সদরদপ্তর হয়ে অভিযোগটি এরই মধ্যে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ওপর তদন্তভার পড়ে। নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আমিনুল ইসলাম এ বিষয়ে তদন্ত করছেন।

মন্ত্রণালয়ে করা অভিযোগে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, পণ্য পরিবহন দেশের অগ্রসরমান একটি শিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত মালিক-শ্রমিকরা দেশের উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯), কনকনে শীত, মুষলধারে বৃষ্টি যে কোনো আবহাওয়ায় শ্রমিকরা দেশের স্বার্থে কাজ করেন।

কিন্তু বন্দরনগরী খ্যাত দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর চট্টগ্রামের সড়কে গাড়ি চলাচল করলেই অভিযুক্ত টিআই জাহিদকে কর দিতে হবে। কাগজপত্রসহ সবকিছু ঠিক থাকলেও মাসে মাসে তাকে টাকা না দিলে নানাভাবে হয়রানি করেন তিনি। এমনকি শ্রমিকদের গায়ে হাতও তোলেন।

পরিবহন নেতারা জানান, সমুদ্রবন্দর, ভোগ্যপণ্যের দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইসহ নানা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে চট্টগ্রামে প্রতিদিনই কয়েক হাজার পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল করে। এসব গাড়ির বিরাট একটি অংশ নগরের একেখান হয়ে জিইসি মোড় ও বায়েজিদ সংযোগ সড়ক হয়ে ২ নম্বর গেট মোড় দিয়ে নগরে প্রবেশ করে। এ দুটি মোড়ের দায়িত্বে আছেন অভিযুক্ত টিআই সুমন জাহিদ লোভেল। সেখানেই তার সঙ্গে মাসিক চুক্তি ব্যতীত সব গাড়ি তিনি দাঁড় করান।

শুরুতে মাসে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে টোকেনের প্রস্তাব দেন। টোকেন না নিলেই কাগজপত্র যাচাইসহ নানাভাবে হয়রানি করেন। তার অত্যাচারে এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলার ট্রাকচালকরা গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রামে আসতে অপারগতাও প্রকাশ করছেন বলে জানা গেছে।

 

তেমনই এক ভুক্তভোগী ট্রাকচালক মো. খোকন। কয়েকদিন আগে ট্রিপ নিয়ে চট্টগ্রামে আসছিলেন। জিইসির মোড়ে তাকে থামানোর সংকেত দেন টিআই লোভেল। কাগজপত্র সব ঠিকঠাক দেখার পরও প্রস্তাব দেন দুই হাজার টাকার বিনিময়ে মাসিক টোকেন নেওয়ার জন্য। কিন্তু টোকেন নিতে অপারগতা প্রকাশ করলে লাইসেন্স নিয়ে তাকে ১০ হাজার টাকার একটি মামলা দেন তিনি।

খোকন বলেন, ‘মামলা দেওয়ার পর তিনি আমার সঙ্গে যা ব্যবহার করেছেন, তা বলার অযোগ্য। ভয়ে আমি এখন চট্টগ্রাম নগরে তার আওতায় থাকা সড়কে ট্রিপই নিচ্ছি না।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান, ট্যাংকলরি ও প্রাইমমুভার মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের সদস্য সচিব মো. তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে দৈনিক আমাদের কয়েক হাজার ট্রাক আসে। এরই মধ্যে টিআই লোভেল ভয়ভীতি দেখিয়ে অনেককে মাসিক দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকার টোকেনের আওতায় নিয়ে এসেছেন। যারা তার মাসিক টোকেন নেননি তাদের তিনি তার আওতায় থাকা সড়ক ব্যবহার করতে দেবেন না বলে জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আমি যখন তার সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি আমার সঙ্গে যা-তা ব্যবহার করেছেন। আমি দীর্ঘদিন পরিবহন সেক্টরে কাজ করছি। তার মতো খারাপ টিআই আমি জীবনে দেখিনি। আমি পরিবহন নেতা হয়েও তিনি আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছেন, তিনি শ্রমিকের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে পারেন চিন্তা করে দেখেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তার বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছি। অভিযোগটি চট্টগ্রাম নগর পুলিশ তদন্ত করছেন। তার চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে আমরা কঠিন আন্দোলনে যাবো।’

জানতে চাইলে অভিযুক্ত টিআই সুমন জাহিদ লোভেল বলেন, ‘আমি আমার এলাকায় নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ দিনেরবেলা কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে দিই না। এছাড়াও গাড়িতে কাগজপত্রের কোনো অনিয়ম থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিই। তাই হয়তো আমার ওপর কেউ ক্ষুব্ধ হতে পারেন। আমি যার গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি তিনিই আমার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন।’

শ্রমিকদের গায়ে হাত তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার দায়িত্ব শুধু টিআই না। পাশাপাশি আমি নগর পুলিশের মোটরযান ইন্সপেক্টর। নগর পুলিশের ৫০০ থেকে ৬০০ গাড়ি আমি দেখাশোনা করি। ট্রাফিক বিভাগে আমি দিনে সময় দিতে পারি মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এর মধ্যে আমি আবার কোন শ্রমিকের গায়ে হাত তুললাম? বিষয়টি আমি জানি না।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়ের হওয়া অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা ও নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আমিনুল ইসলাম বলেন, অভিযোগটি তদন্তাধীন। এরই মধ্যে বাদী-বিবাদীসহ ঘটনায় জড়িতদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আরও তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.