সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রাসঙ্গিক ভাবনা: ড. আহসান সাইয়েদ

‘আন্তরিকতা’ এবং ‘সদিচ্ছা’ শব্দ দু’টি পৃথক হলেও এদের মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধ রয়েছে। যেখানে ইচ্ছা সৎ হয় সেখানে অনিবার্য বিষয় হিসাবে আন্তরিকতা সম্পৃক্ত হয়। ইচ্ছা যেখানে শিথিল, এলোমেলো এবং দায়িত্ব নির্বাহে কুন্ঠিত সেখানে আন্তরিকতাও দুর্বল, মেরুদন্ডহীন এবং দৃঢ়তাবর্জিত। সুতরাং বলা যেতে পারে সদিচ্ছাই বড় কথা, প্রধান কথা। সদিচ্ছা যেখানে থাকে আন্তরিকতা সেখানে আগুণের শক্তির মত প্রবেশ করে এবং সেই ইচ্ছার অধীনে ইচ্ছা শক্তিকে বাড়িয়ে তুলে কঠিন কাজকে সহজ করে তোলে। যদি আপনার ইচ্ছা থাকে তাহলে আপনিও হতে পারেন জ্ঞানী,গুণী, ধনী, আলোচিত উজ্জ্বল নক্ষত্র। আপনার ইচ্ছাশক্তি আপনাকে করবে বিখ্যাত, জননন্দিত ও বিশ্ববরেণ্য। আপনিও হতে পারেন আলোকিত মানুষদের একজন। সদিচ্ছা ও আন্তরিক কর্মস্পৃহা থাকলে মরতে বসা দুর্গন্ধভরা প্রতিষ্ঠানকেও আদর্শিক ও স্বচ্ছ সুন্দর কর্মমুখর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা যায়। তবে অসৎ কর্মেও মানুষের অনুপ্রেরণা বা আন্তরিকতা কম থাকে না। আদিকাল থেকে বিশ্বে প্রভাব বিস্তারকারী যে শক্তির লড়াই চলছে সেটা শুভ ও অশুভের লড়াই, দেব-দৈত্যের লড়াই, মানব-অমানবের লড়াই। একদিকে আছে শাদ্দাদ, ফেরাউন, নমরূদ, আবু লাহাব, ইয়াজিদ প্রমুখ, অন্যদিকে আছে মুসা (আ:), ঈসা (আ:), রসুল (সা:) হোসেন (রা:) প্রমুখ। একদিকে আছে রাবণ, কংস, মহিষাসুর, অন্যদিকে আছে রাম কৃষ্ণ, দুর্গা প্রমুখ। এই যে অসুর শক্তি বা শয়তান শক্তি বিভ্রান্ত শক্তিতে উদ্ভুত হয়ে তারাও নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে বিপুল বিস্ময় জাগায়। এখানে ইচ্ছা যে সৎ সে কথা বলা যাবে না, কিন্তু ইচ্ছা যে শক্তিশালী সেটা বলা যুক্তিসঙ্গত। অসৎ ও সৎ ইচ্ছা শক্তির এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা জগতের প্রাণশক্তি বলে অনেক মনীষীর ধারণা। আমরা যে জীবনকে দেখছি সেও যতটা আলোর কাছে ঋণী ততটা অন্ধকারের কাছে। মহাকবি ইকবালের ‘জিব্রাঈল ও শয়তান’ কবিতায় শয়তানকে বলতে শুনি- আমার বিদ্রোহে মুক্ত বুদ্ধি মননের বস্ত্রে ধুলিমুষ্টি চলেছে সম্মুখে। সত্য-অসত্যের দ্বন্দ্বে দ্রষ্টা তুমি দুরবর্তী দুরপ্রান্তে আছো দিবাযামী। প্রমত্ত ঝঞ্জার বুকে কে জাগে সংগ্রামী চিত্ত, জিব্রাঈল! তুমি কিংবা আমি? খিজির সহায়হারা অসহায় ইলিয়াস সে ঝড়ের প্রচন্ড গতিতে আমরা ঝঞ্জার পথ সমুদ্রে সমুদ্রে আর তরাঙ্গিত নদীতে নদীতে। তবু তুমি এই প্রশ্ন শুধায়ো আল্লাহর কাছে পাবে তার যখন দিদার, মানুষের ইতিহাস উজ্জ্বল হয়েছে আজ অফুরন্ত প্রাণরক্তে কার? (অনুঃ ফররুখ আহমদ) মহাকবি ইকবাল এই রহস্যময় তাত্ত্বিক কথার মন্ত্র মিল্টনের কাছ থেকে পেয়েছিলেন কিনা জানি না তবে জীবনকে সক্রিয় রাখার পিছনে শয়তান শক্তির অবদানকে উড়িয়ে দেয়ার মত নয়। মানুষের যারা শুভাকাঙ্খী বা হিতাকাঙ্খী তাদের সকলেই আলোর প্রার্থনা করে। শেক্সপিয়ারও লাইট লাইট বলে আলোর প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার এক গানে লিখেছেন- ‘ও আমার আঁধার ভালো আলোর কাছে থেকে থেকে।’ নজরুল ইসলাম তার ‘রৌদ্রদগ্ধের গানে’ এই ধরনের প্রার্থনা করেছেন- এবার আমার জ্যোতির্গেহে তিমির প্রাদীপ জ্বালো। আনো অগ্নি-বিহীন দীপ্তি শিখার তৃপ্তি অতল কালো। এই তাত্ত্বিক আলোচনা আরও বিশদ করার প্রয়োজন নেই। তবে সদিচ্ছা শব্দটি যদি অপশক্তি তার ইচ্ছাশক্তির আন্তরিকতার অর্থে গ্রহণ করে তাতে দোষের কিছু থাকে না। ব্যাপারটা হল মানুষ যেখানে থেকেই তার কর্মদায়িত্ব পালন করুক সেটা নিষ্ঠার সঙ্গে তাকে পালন করতে হবে। যার কাজের পিছনে সাধনা, অধ্যবসায়, তপস্যা, মনোনিবেশ, পরিশ্রম ও আন্তরিকতা থাকে সে যে কোন কাজে লেগে থাকুক তাতে সাফল্য লাভ করবেই। একজন কবিতা লেখার সাধনা করে যেমন বড় কবি হতে পারেন, তেমনি একজন উপন্যাস, গল্প, নাটক প্রবন্ধ লিখেও বড় ঔপন্যাসিক, গল্পলেখক, নাট্যকার বা প্রবন্ধকার হতে পারেন, বিজ্ঞান গবেষণা ও চর্চায় নিযুক্ত থেকে হতে পারেন একজন নিউটন, আইনষ্টাইন বা আবদুস সালাম; সঙ্গীত-চর্চায় নিবেদিত হয়ে একজন হতে পারে বেটোফেন, মোজার্ট, আমীর খসরু বা নজরুল ইসলাম। একজন ফুটবল খেলে যেমন পেলে, ম্যারাডেনা বা বেকেনবাওয়ার হতে পারেন তেমনি একজন ক্রিকেট খেলে হতে পারেন ব্র্যাডম্যান, সোবার্স, ব্রায়ান লারা বা ইমরান, কুস্তি খেলে হতে পারেন গোলাম মুহাম্মদ (গামা) বা মুষ্টিযুদ্ধ খেলে হতে পারেন মুহাম্মদ আলী, জো লুই। সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়ে আজকের প্রয়াসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আমাদের দেশের জন্যে একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে উঠেছে। জাতি হিসেবে উন্নতির উচ্চাসনে পৌঁছার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় যে প্রকৃত সদিচ্ছার অভাব- তাতে সন্দেহ নেই। যিনি যেখানেই কাজ করুন, যে বিষয় নিয়ে কাজ করুন সেখানে যদি তিনি তাঁর সকল সদিচ্ছা ও আন্তরিকতাকে কাজে লাগিয়ে গভীর মনোনিবেশ ও কঠোর পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে কাজ করেন তাহলে তাতে শুধু তাঁর ব্যক্তিগত উন্নতিই ঘটাবেন না দেশেরও উন্নতি ও সমৃদ্ধি ঘটাবেন নিঃসন্দেহে। ফোঁটা-ফোঁটা পানি একত্রিত হয়ে যেমন সাগর হতে পারে তেমনি অজস্র ব্যক্তির একক বা সমবেত সাফল্য সামগ্রিক সাফল্যের উৎস হতে পারে। দুঃখের বিষয় আমাদের জাতির মধ্যে সেই নিষ্ঠা, সেই অধ্যবসায়, সেই পরিশ্রম, সেই তপস্যার দৃঢ়তার দারুণ অভাব লক্ষ্য করা যায়। এরই জন্যে এদেশের মধ্যে ভীষণভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছে ফাঁকির প্রবণতা ও দুর্নীতি। এখানে একটি কথা বলা বোধ হয়ে আমাদের উচিত। সেটা হল প্রেম বা ভালোবাসা। মানুষ যে বিষয়কে ভালোবাসে সে জিনিসকে পাওয়ার জন্যে সে তার জীবন উৎসর্গ করতেও পিছ পা হয় না। অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন যে হিটলারের মত একটি মানুষের পিছনে গোটা জার্মান জাতি কিভাবে সংঘবদ্ধ হয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, হিটলারের জন্যে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি জার্মানীর জন্যে জার্মানদের প্রেমের জন্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। একটি জাতি ইস্পাত কঠিন মনোভাব নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হলে যে অসাধ্য সাধন করতে পারে বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে হিটলারের জার্মান বাহিনী তা প্রমাণ করেছিল। অনুরূপভাবে স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিটলারের বিরুদ্ধ শক্তিসমূহ অব্যবহিত পরেই দুর্দম জার্মান বাহিনীকে পরাভূত করেছি

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.