পুরস্কার পেতে এসিল্যান্ডের সহায়তায় লোহাগাড়া ওসির অবৈধ মোবাইল কোর্ট!

 

নিজস্ব প্রতিবেদক

আইনানুযায়ী একজন আসামি পুলিশের হাতে আটকের পর সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে নিকটতম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করতে হয়। এক্ষেত্রে কোনোভাবে তাকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে সাজা দেওয়া যায় না। তবে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানা পুলিশ একাধিকবার আসামি গ্রেপ্তার করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করে সাজা নিশ্চিত করছে। এতে আইনের একদিকে আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে। অন্যদিকে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এদিকে, খোঁজ নিয়ে এ কাজের পেছনে লোহাগাড়া থানা অফিসার ইনচার্জের (ওসি) ভিন্ন উদ্দেশ্য জানা গেছে। বিভিন্ন বিপন্নপ্রায় বন্যপ্রাণী উদ্ধারে সফল অভিযান পরিচালনা করলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের পুরষ্কৃত করা হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে আটকের পর অভিযুক্তরা কতটুকু সাজা পেয়েছে সেটিও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এ কারণে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানা ওসি গ্রেপ্তারের পর আসামিকে আদালতে প্রেরণ না করে উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করেন। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অথবা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ কারাদণ্ড এবং জরিমানা নিশ্চিত করেন।

 

এর আগে ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল কামরুন নাহার জেলার সকল অফিসার ইনচার্জদের সতর্ক করে একটি আদেশ জারি করে। এতে তিনি উল্লেখ করেন- ওসিরা আটককৃত আসামিদেরকে নিয়মিত আদালতে সোপর্দ না করে সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইউএনও এবং এসিল্যান্ডের নিকট উপস্থাপন করছেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর সুস্পষ্ট বিধান লঙ্ঘন করে আসামিদেরকে আইনবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করছেন। যা দেশের সংবিধান এবং প্রচলিত অন্যান্য আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

 

 

আদেশে আরও বলা হয়, এ বিষয়ে সতর্ক করা হচ্ছে যে, পুলিশ কর্তৃক আটক আসামিদের ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্টের রায়ের সিদ্ধান্ত মান্য না করে আইন বহির্ভূত মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় সহায়তা করার কোনো সংবাদ আদালতের গোচরীভূত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের কারণে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং বিষয়টি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টকে অবহিত করা হবে। আদেশটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি, চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার, জেলার সকল ওসিকে নির্দেশনা দেন আদালত।

 

 

আইনজীবীরা জানিয়েছেন, জুডিশিয়াল আদালতে একজন আসামির বিরুদ্ধে সাজা নিশ্চিত করতে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রথমে মামলা দায়ের করতে হয়। এরপর মামলাটি তদন্ত করে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিতে হয়। অভিযোগপত্র বিবেচনা করে আদালতে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। বিচারিক প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এরপর আদালত রায় ঘোষণা করেন। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ক্ষেত্রে এসবের দরকার নেই। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অপরাধ সংঘটিত হলে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষ স্বীকার করলে তৎক্ষনাৎ সাজা দেওয়া যায়। তবে লোহাগাড়ার ক্ষেত্রে আটকের পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডেকে সাজা দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি ওসি নিজেই স্বীকার করেছেন।

জানা গেছে, শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) বেলা সাড়ে ১২টার দিকে লোহাগাড়ার বার আউলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে অভিযান পরিচালনা করে দুটি লজ্জাবতী বানর ও একটি প্যাঁচা উদ্ধার করে পুলিশ। একই সঙ্গে পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে আটক করা হয়। তারা হলেন- মো. মোবারক হোসেন (২৭), সাদ্দাম হোসেন (২৭), মো. মহিউদ্দিন (২৪) ও মো. আজাহার সিকদার (৪২)।

 

 

এর আগে গত বছরের গত ৮ অক্টোবর লোহাগাড়ার চুনতি অভয়ারণ্যের ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে যাত্রীবাহী বাস থেকে একটি উল্লুক উদ্ধার করা হয়। এদিন উল্লুক পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় মো. মুবিন (৩০) ও মাজহারুল (৩৫) নামের দুজনকে। পরে তাদেরকে উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক বছর কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

 

 

এভাবে বন্যপ্রাণী উদ্ধারের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত ডেকে সাজা নিশ্চিত করার বিষয়ে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদক। তারা জানান, বন্যপ্রাণী উদ্ধারের এসব অভিযান ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল) তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অভিযানে অংশ নেওয়া সফল পুলিশ কর্মকর্তাকে পুরষ্কৃত করা হয়। একই সঙ্গে আরও নির্দেশনা থাকে সফল অভিযানের পাশাপাশি আসামিদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট পরিমাণ সাজা নিশ্চিত করতে হবে। এই পুরষ্কার নিশ্চিত করতে লোহাগাড়া থানার ওসি বেছে নেন সহজ পথ। তিনি আসামিদের আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের সহযোগিতা নেন। উপজেলায় কাজ করার সুবাদে অনেকটা ওসির আবদার রক্ষা করতে গিয়ে ইউএনও-এসিল্যান্ডরা শাস্তি দিয়ে থাকেন।

 

 

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, পুলিশ গ্রেপ্তার কোনো আসামিকে এসিল্যান্ড, ইউএনও বা কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তুলে দিয়ে সাজা দিতে পারে না। একজন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে তাকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিকটতম জুডিশিয়াল আদালতে সোপর্দ করতে হবে। বিলম্ব হলে তার কারন উল্লেখ করতে হবে। ঘটনা উদঘাটন, উদ্ধার ও তদন্তের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আদালতের অনুমতি নিয়ে রিমান্ডে নিয়ে যেতে পারবেন। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার আসামিকে তাৎক্ষনিক মোবাইল কোর্ট বসিয়ে সাজা দেয়ার কোনো বিধান আইনে নেই। এটা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অজ্ঞতা বা ক্ষমতার অপব্যবহার। এ ধরণের মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী অনেকের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা উচ্চ আদালত কেড়ে নিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে কোনো অপরাধ সংগঠিত হলে অপরাধীর দোষ স্বীকারের ভিত্তিতে তাকে জেল জরিমানা দেয়া যায়। আইনের ছাত্র ছিলেন না বা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবে কতিপয় অতিউৎসাহী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্টের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। এ কারণে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া অন্য কেউ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা উচিত নয়।

 

এ বিষয়ে লোহাগাড়া থানার ওসি আতিকুর রহমান বলেন, লজ্জাবতী বানর ও প্যাঁচা উদ্ধারের বিষয়টি আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. শরীফুল্লাহকে অবহিত করি। তিনি সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শাহাজাহানকে তাৎক্ষনিক অভিযান দলের কাছে প্রেরণ করেন। তিনি অবৈধভাবে পাচারের উদ্দেশ্যে বন্যপ্রাণীগুলো শিকার ও হেফাজত রাখার অপরাধের বিষয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে চারজনের প্রত্যেককে ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

 

 

লোহাগাড়ায় ওসি কতৃক অবহিত হয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহজাহানকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে তাকে নিউজের বিষয় লিখে এসএমএস দেওয়া হয়। জবাবে তিনি লেখেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতে অপরাধ উদঘাটিত হলে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ বিষয়ে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এর ধারা ৬ (১) এ নির্দেশনা রয়েছে।

 

এ নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, নির্দেশনাটি ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ঘটলে প্রযোজ্য হবে। লোহাগাড়ার ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা কালে কেউ আটক হয়নি। আটকের পর মোবাইল কোর্ট গঠন ও সাজা সম্পূর্ণ বেআইনি। এক্ষেত্রে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট উভয়েই আইন ভঙ্গ করেছেন।

 

ঢা/পো:/মি/র

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.