অপেক্ষা কয়লার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াবে ৩০ হাজার মেগাওয়াট

 

চট্টগ্রাম ব্যুরো: জুনে পূর্ণমাত্রায় বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট’। যদিও এপ্রিল থেকে সেটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমদানি করা কয়লাবোঝাই জাহাজ জেটিতে ভেড়ানোর পথ তৈরি করতে না পারায় উৎপাদন পিছিয়ে যায়।

তবে এপ্রিল থেকে অন্তত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে বলে এস এস পাওয়ার প্ল্যান্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোদমে চালু হলে দেশে উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীরবিক্রম।

বঙ্গোপসাগরের তীরে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারায় ৬০৬ একর জমিতে চলছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল এই কর্মযজ্ঞ। রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে। দেশি-বিদেশি প্রায় সাত হাজার শ্রমিকের দিন-রাত শ্রমে গড়ে উঠছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পুরোদমে উৎপাদন শুরু হলে এই কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে ১২২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হবে। বাস্তবায়ন শেষে প্রায় ১২০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে।

প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে যৌথভাবে বিনিয়োগ করেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ ও চীনা প্রতিষ্ঠান সেপকো-এইচটিজি। এই প্রকল্পের ৭০ শতাংশের মালিকানা এস আলম গ্রুপের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের মধ্যে সেপকো ২০ শতাংশ এবং চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান এইচটিজি ১০ শতাংশের মালিক।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও এসএস পাওয়ারের মধ্যে চুক্তি সইয়ের পর ২০১৬ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ যৌথভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং। চুক্তিতে ৪৫ মাসের মধ্যে প্রকল্প শেষ করার বাধ্যবাধকতা ছিল। সে হিসাবে ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর কেন্দ্রটিতে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় পরে সময় বাড়ানো হয়। চুক্তি অনুযায়ী পিডিবি ২৫ বছর ধরে এই কেন্দ্রে উৎপাদিত সব বিদ্যুৎ কিনবে।

কেন্দ্রের দুই ইউনিটের প্রতিটির উৎপাদনক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট। উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বাঁশখালী থেকে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট পর্যন্ত সঞ্চালন লাইনের ১৯৮টি টাওয়ার বসানো হয়েছে। মদুনাঘাট সাব-স্টেশনে যে গ্রিড আছে, সেই গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হবে। সঞ্চালন লাইনটি তৈরি করেছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।

রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি পরিদর্শনে আসেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালনি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম। সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান ও পিডিপি, পিজিসিবিসহ বিভিন্ন সংস্থার ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারা। প্রথমে উপদেষ্টাসহ কর্মকর্তারা এস এস পাওয়ার প্ল্যান্টের বিনিয়োগকারী ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন।

বৈঠক শেষে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ লাবু আগামী জুনে দুই ইউনিট থেকে পূর্ণমাত্রায় বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর ঘোষণা দিয়ে দুই মাস পেছানোর কারণ ব্যাখা করেন।

 

আবদুস সামাদ লাবু বলেন, ‘আমরা সাগরপথে কয়লা আনার চ্যানেলটা এখনও তৈরি করতে পারিনি। মার্চের মধ্যে আমাদের প্রথম ইউনিট চালুর কথা ছিল। অন্তত ৫০০ মেগাওয়াট পাওয়া যেত। আমরা এটা বর্ধিত করে এপ্রিলে নিয়ে গেছি। ব্রেক ওয়াটারের (দুই পাশে কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করে জেটিতে জাহাজ নোঙ্গরের চ্যানেল চালু করা) কাজটা আমরা মার্চের মধ্যেই শেষ করে ফেলব। মার্চের শেষের দিকে কয়লা আসবে। মে মাসের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট চালু করতে পারব বলে আমরা আশা করছি। কাজ শেষ করে ২২ জুনের মধ্যে দুটি ইউনিট থেকে ন্যাশনাল গ্রিডে বিদ্যুৎ দিতে পারব। ট্রান্সমিশনের কাজ শেষ করে ফুল লোডে কাজ শুরু করতে পারব।’

বিভিন্ন সংস্থার উচ্চপর্যায়ের টিমের সঙ্গে সমন্বয় করেই পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি একা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তো ন্যাশনাল গ্রিডে দিয়ে দিতে পারব না। এজন্য সবার সঙ্গে সমন্বয় লাগবে। এখানে ৫/৬টা ডিপার্টমেন্ট কাজ করে। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়ারটা যাবে মদুনঘাটে। সেখানে গিয়ে পাওয়ারটা আপ-ডাউন হবে। তখন অনেককিছু সমন্বয় করতে হবে। সেজন্য চারটা হাই পাওয়ার টিম এখানে এসেছে। ট্রান্সমিশনের এমডি, পিডিবির এমডি, পাওয়ার সেলের ডিজি, অ্যাডভাইজার সাহেব এসেছেন এবং সচিব মহোদয়ও এসেছেন। টিমওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

মার্চের শেষে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লার প্রথম চালান আসবে জানিয়ে আবদুস সামাদ লাবু বলেন, ‘প্রথম চালানটা আমরা ইন্দোনেশিয়া থেকে আনছি। কয়লার জন্য ১৫ বছরের চুক্তি আছে ওদের সাথে। সুতরাং কয়লার উৎসে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। প্রথম চালানে আসবে ২০ হাজার মেট্রিকটন। এরপর আসবে আরও দুই লাখ মেট্রিকটন। ইন্দোনেশিয়ার বিকল্প হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও চুক্তি করা আছে। দুইদেশের সঙ্গে আমাদের বার্ষিক চার মিলিয়ন টন কয়লার চুক্তি আছে বার্ষিক।’

 

ইউনিট প্রতি ৯ টাকায় জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দামটা অবশ্য ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজের ওপর নির্ভর করবে। এখন সব খরচ মিলিয়ে নয় টাকার নিচে পড়বে। তবে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে কয়লার দাম কমলে বিদ্যুতের দামও কমবে।’

বিনিয়োগকারী গ্রুপের প্রশংসা করে উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘এসএস পাওয়ার ব্যক্তিগত খাতে আড়াই বিলিয়ন ডলারের ওপরে একটা প্রকল্প নিয়েছে, এটা বাংলাদেশের জন্য গর্বের ব্যাপার। সব প্রকল্প এক না। কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। অর্থায়ন নিয়েও চ্যালেঞ্জ আছে। সারা পৃথিবীতে কেউ কয়লার জন্য অর্থায়ন করতে চায় না। সেখানে তারা অর্থ সংগ্রহ করেছে। চাইনিজ ব্যাংকগুলো এগিয়ে এসেছে। এটা বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বিরাট একটা অর্জন।’

এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট চালু হলে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা কোথায় দাঁড়াবে?- এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘৩০ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে চলে যাবে। তবে মোট ক্যাপাসিটির ২০ শতাংশ বাদ দিতে হবে। কারণ স্পিনিং রিজার্ভ রাখতে হয় ১০ শতাংশ, ইঞ্জিন চলে কিন্তু প্রোডাকশন বসে গেল, এই কারণে। তারপর রিপেয়ার মেইনট্যানেন্সে লাগে আরও ১০ শতাংশ। সুতরাং এটা বাদ দিতে হবে।

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.