বাজারে বাড়তি দামের লাগাম টানতে চাহিদার বিপরীতে গত বছরের শেষ ছয়মাসে আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৩৩ হাজার টন চিনি। আসন্ন রমজান উপলক্ষে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে এসেছে আরো ৪ লাখ ১৯ হাজার টন চিনি। এর প্রভাবে খাতুনগঞ্জে পাইকারি বাজারে দাম কমলেও তা সাধারণ ক্রেতা পর্যায়ে কোনো প্রভাব ফেলেনি। খুচরা বাজারে চিনির দাম আগের মতোই।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবছর শুধু রমজান মাসেই সাড়ে ৩ লাখ টন চিনির চাহিদা তৈরি হয়। এর বিপরীতে এখন পর্যন্ত সাড়ে ১১ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছে। রোজার আগে পর্যায়ক্রমে আরো প্রায় ৪ লাখ টন চিনি আসবে। চিনির সরবরাহ বাড়ায় প্রতিমণে ৪০ টাকা কমেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ছয় মাসে ৭ লাখ ৩৩ হাজার টন চিনি আমদানি হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ৪ লাখ ১৯ হাজার টন চিনি আমদানি হয়েছ। অর্থাৎ জানুয়ারিতে ১ লাখ ৭৮ হাজার টন এবং ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচটি জাহাজে করে এসেছে ২ লাখ ৪১ হাজার টন চিনি। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১১ লাখ ৫২ হাজার টন চিনি আমদানি হয়েছে।
খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মাসে খাতুনগঞ্জে প্রতিমণ চিনি বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার টাকার উপরে। বর্তমানে পাইকারিতে এস আলমের চিনি মণপ্রতি ৩ হাজার ৯২৫ ও সিটি গ্রুপের চিনি ৩ হাজার ৯৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের চিনি ব্যবসায়ী ইসমাইল ট্রেডার্সের মালিক মো. রাজ্জাক সিভয়েসকে বলেন, ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার করার কারণে চিনি আমদানি ব্যাহত হয়েছিল। তার উপর গত মাসে ডলার না পেয়ে বিদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো জাহাজ থেকে চিনি খালাসের অনুমতি দেয়নি। চিনিভর্তি বেশ কয়েকটি জাহাজ প্রায় দুমাস ধরে সাগরে ভেসেছিল। তাই চাহিদার তুলনায় চিনির সরবরাহ কম ছিল। এখন আমদানি বেড়েছে। রমজান উপলক্ষে পর্যাপ্ত চিনি আমদানি হয়েছে। যা সরবরাহ আছে তা দিয়ে নিমিষেই চাহিতা মেটানো যাবে। পাশাপাশি সরবরাহ বাড়ায় চিনির দামও কমতে শুরু করেছে।
এর আগে গত ২৬ জানুয়ারি চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ১১২ টাকা ও খোলা চিনি ১০৭ টাকায় বিক্রির নির্দেশনা দেয়। তার উপর বর্তমানে পর্যাপ্ত পরিমাণে চিনিও আমদানি হয়েছে। অথচ পাইকারিতে চিনির দাম কমলেও খুচরা বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দরে। নগরের বিভিন্ন এলাকার খুচরা দোকান ঘুরে দেখা গেছে, প্যাকেটজাত চিনি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা ও খোলা চিনি ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নগরের হালিশহর এলাকার মদিনা স্টোরের মালিক মো. শাহজাহান সিভয়েসকে বলেন, এটা ঠিক যে পাইকারিতে চিনির দাম কমতির দিকে। তবে চিনির বস্তা কিনে আনতে আমাদের পরিবহন খরচ, শ্রমিকের মজুরি দিতে হয়। আমরা যদি নির্ধারিত দরে চিনি বিক্রি করি তাহলে তো ব্যবসা করে আর লাভ নেই।
রমজানকে সামনে রেখে বাজারে চিনির মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এক পরিপত্রে চিনির আমদানি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার এবং অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫ শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। যদিও ভোক্তাদের দাবি, এসব কোনকিছুরই সুবিধা ক্রেতারা ভোগ করতে পারবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমদানিকারক ও পাইকারদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে। এর জন্য প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
নগরের আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, প্যাকেট চিনির গায়ে ১০৮ টাকা লেখা, অথচ খুচরা বিক্রেতারা ১২০ টাকায় বিক্রি করছে। আর খুচরা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকায়। সব খুচরা দোকানেই একই অবস্থা চলছে। রোজার আর বেশিদিন নেই। রমজান মাসে চিনি ছাড়া চলা যায় না। এটাকে পুঁজি করে খুচরা ব্যবসায়ীরা বাড়তি দরে চিনি বিক্রি করেই যাচ্ছেন। তাই প্রশাসনকে শুধু হাটবাজারে নয়, অলিগলির খুচরা দোকানগুলোতেও অভিযান চালাতে হবে। পণ্যের মূল্য তালিকা লাগানো নিশ্চিত করতে হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আনিছুজ্জামান সিভয়েসকে বলেন, পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে আমরা ইতোমধ্যে বাজার তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করেছি। ভোক্তাদের অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। সে অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা আমাদের সীমিত জনবল দিয়ে সাধ্যমত ভোক্তার ভোগান্তি নিরসনে কাজ করে যাচ্ছি। তবুও কেউ বাড়তি দরে ভোগ্যপণ্য বিক্রি করছে তা আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিব।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন সিভয়েসকে বলেন, চিনির দাম তো বহুবার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সেটা ওই কাগজে কলমে থেকে গেছে। একবারও বাস্তবায়িত হয়নি। পাইকারি-খুচরা সকল ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে বাড়তি দরে চিনি বিক্রি করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন। রমজান মাস আসছে। ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফালোভী মনোভাব দূর করতে হবে। ক্রেতাদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার, বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে নজরদারি বাড়াতে হবে। কঠোর অবস্থানে যেতে হবে।