বাবা বলতেন আমার ছেলেকে পুলিশের পোশাকে বেশি স্মার্ট লাগবে!

মো: জাকারিয়া রহমান জিকু। আত্মবিশ্বাসী ও উদ্যমী এক পুলিশ কর্মকর্তা। বাবা-মায়ের আস্থা আর আশীর্বাদকে পূঁজি করে যার এগিয়ে চলা। ২৯তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেলেও বাবার ইচ্ছায় পরে ৩০তম বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দেন পুলিশ ক্যাডারে।

বাবা-মায়ের আদর্শে বেড়ে ওঠা জিকু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে শেখেননি। জীবনের ছোট-বড় সব ব্যর্থতাকেই নিয়েছেন সফলতার এক একটি সোপান হিসেবে।

এভাবে নিজেকে পরিপূর্ণ করে প্রতিনিয়ত সামনে এগিয়ে চলা জাকারিয়া জিকু বর্তমানে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত আছেন।

ঝিনাইদহের শৈলকূপার ছেলে জিকু ছোট থেকেই ছিলেন স্বাধীনচেতা। এসএসসি পর্যন্ত বাবা-মায়ের কথামতো বিজ্ঞান বিভাগে পড়লেও একসময় সারাদিন লেখা-পড়া, দিনের মধ্যে ৭ থেকে ৮ জন শিক্ষকের বাসায় পড়তে যেয়ে হাঁপিয়ে উঠতে শুরু করেন আড্ডাপাগল ছেলেটি। সেজন্য এইচএসসিতে বদলে ফেলেন বিভাগ। শুরু করেন মানবিক বিভাগে পড়া। এলাকার এক বড় ভাইকে দেখে স্বপ্ন বুনতে থাকেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।

ভীষণ জেদী জিকুর স্বপ্ন ছিলো একটাই; হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন নয়তো গ্রামে কৃষিকাজ করেবেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সফল হওয়ায় এগিয়ে যান জীবনের আরও একটি ধাপ।

সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়ার সুযোগ পেয়ে শুরু হয় তার নতুন জীবন। বন্ধু আড্ডায়, বিভাগের ক্লাস-পড়াশোনায় স্বপ্নের মতো কাটতে থাকে সময়।

জিকুর চিন্তা-ভাবনার মোড় ঘুরে যায় অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়াকালে। কিছু জরুরি কাগজ সত্যায়নের প্রয়োজনে এলেনবাড়ি বিআরটিএ অফিসে যান। সেখানে এক সহকারি পরিচালকের রুমে গেলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় তাকে। কর্মকর্তার রুমে যাওয়া মাত্রই সেই কর্মকর্তা রুঢ় কণ্ঠে জিকু’কে বলে ওঠেন, ‘‘আমি কী আপনার কাগজ সত্যায়িত করার জন্য এখানে বসে আছি?’’

এ কথায় ভীষণ আঘাত পান জিকু। কর্মকর্তার রুম থেকে বের হওয়ার সময় দৃঢ়স্বরে শুধু একটি কথাই বলেন: ‘‘আমি আপনার চেয়ে বড় অফিসার হবো।’’

আর সেই জেদ থেকেই শুরু করেন বিসিএসের প্রস্তুতি। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরের গল্পটা শুধুই সফলতার। ২৯তম বিসিএসে সফল হয়ে যোগ দেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দেন নীলফামারী জেলায়। সেখানে চাকরিরত অবস্থায় ৭ মাস পর যখন বাড়িতে যান জিকু; দূর থেকে দেখতে পান বাবা একটি চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছেন। কাছে যেতেই বাবা বলে ওঠেন ‘‘নাহ আমার ছেলেকে পুলিশের পোশাকেই বেশি স্মার্ট লাগবে’’।

কথাটা ভীষণভাবে অন্তরে ধারণ করেন জিকুৃ। এবার লড়াইটা বাবার স্বপ্ন পূরণের। ৩০তম বিসিএসের ফলাফল প্রক্রিয়াধীন সেসময়। কিছুদিন পরই প্রকাশ হয় ফল। বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে দেখতে পান নিজের রোল নম্বরটি। সেই মূহুর্তে স্বপ্ন যেনো আকাশ ছুঁয়ে যায়।

জিকুর ভাষায়: বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণের অনুভূতি যে কী ভীষণ ভালোলাগার তা বলে বোঝাতে পারবো না। সেদিন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ মনে হচ্ছিলো।”

এরই মধ্যে কর্মজীবনে পার করেছেন নানা-চড়াই উৎরাই। এক বছর কাজ করে এসছেন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনেও। কর্মক্ষেত্রে কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ পেয়েছেন নানা পুরস্কার।

নিজ পেশা থেকে দেশের জন্য কীভাবে কাজ করতে চান? এ প্রশ্নের উত্তরে এই কর্মকর্তা বলেন:

“আমি যে পদে, যে দায়িত্বে যেখানেই থাকি না কেনো আমার সেই অফিসের সিটিজেন রাইটস তথা জনগণের সেবা দেয়ার জন্য আমাকে রাখা হয়েছে। সেই সেবা আন্তরিকতা ও মানবিকতার সাথে দিতে পারলেই দেশের জন্য জনগণের জন্য কাজ করা হবে।”

তিনি বিশ্বাস করেন যার যার অবস্থান থেকে আন্তরিকতার সাথে একটু মানবিকতার মিশ্রণ ঘটিয়ে দায়িত্ব পালন করলেই দেশের জন্য প্রকৃত কাজ করা হবে।

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন: “নিজেকে জানার কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি বুঝতে পারে সে কী পারে আর কী পারে না তাহলে তার জন্য প্রস্তুতিটা অনেক সহজ হয়ে যায়।”

“সিলেবাস একটা বড় বিষয় সেটা ভালোভাবে বুঝলে অর্ধেক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যায়। এরপর বিগত ২০ থেকে ২৫ বছরের যতো প্রশ্ন আছে সব মন দিয়ে পড়তে হবে। এতে করে প্রশ্নের ধরণ সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা পাওয়া যাবে। আর সেখান থেকে প্রতিবছরই প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রশ্ন কমন পড়ে থাকে।” ‍

জিকু আরো বলেন, “দুর্বল বিষয়টা জোর দিয়ে পড়তে হবে। প্রতি সপ্তাহে নিজেকে মূল্যায়নের জন্য দিতে হবে বেশি বেশি পরীক্ষা। পড়ালেখাটাকে শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বইয়ের বাইরে জানার আগ্রহ থাকতে হবে বিস্তর।

মেধাবী এ কর্মকর্তা বলেন: সময় ভাগ করে প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা জরুরি। সব উত্তরের মান যেনো সমান হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একটার উত্তর অনেক ভালো, আরেকটা মোটামুটি হলে গড় নম্বরটা কমে যায়। সেজন্য সব প্রশ্নের উত্তর সমানভাবে দেয়ার চেষ্টা করতে হবে।”

সর্বোপরি সততা, পরিশ্রম ও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণকেই সফলতার মূলমন্ত্র বলে মনে করেন তিনি। সম্পাদনায়: আই এইচ

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.