আনোয়ারা প্রতিনিধি:
রমজান মাস ঘিরে তোড়জোড় বেড়ে যায় ভেজাল ঘি তৈরির। বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে নিম্নমানের কেমিক্যাল দিয়েই তৈরি করা হয় ভেজাল ঘি। থাকে সুন্দর মোড়ক ও বাহারী নাম। তবে রমজান মাসে বাজার তদারকি ব্যবস্থা জোরালো থাকায় এসব ঘি সহজে বাজারজাত করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। গ্রামকে টার্গেট করেই এসব ভেজাল ও মানহীন ঘি বাজারজাত করা হয়। ডালডা আর পাম ওয়েলের সঙ্গে সামান্য পরিমাণে ঘি, ফেভার আর রঙ মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে গাওয়া ঘি। আর এসব ঘি বাহারি নাম দিয়ে কৌটাজাত করা হচ্ছে। এরপর বিএসটিআই‘র নকল সিল বসিয়ে অবাধে বাজারজাত করা হচ্ছে। রমজান উপলক্ষে ঘিয়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর তৈরি এসব ভেজাল ঘিয়ে এখন সয়লাব হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার।
গত বুধবার বিকালে উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নে আমান উল্লাহ্ পাড়া এলাকায় ভেজাল ঘি তৈরীর এম.এস ঘি নামে একটি কারখানায় অভিযান চালিয়েছেন উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. তানভীর হাসান চৌধুরী। এ সময় ভেজাল ঘি কৌটা, পাম অয়েলসহ ক্ষতিকারক রং ও ঘি তৈরির নানা সরঞ্জাম জব্দ করে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন তিনি।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে নামি-দামি কোম্পানির মোড়ক লাগিয়ে অত্যাধুনিক মেশিনে টিনের কৌটাজাত করে উপজেলায় বিভিন্ন বাজারে বাজারজাত করে অসছিল ভেজাল ঘি তৈরির একটি চক্র। এতে ঘি এর কোন উপাদান নেই অথচ ‘খাঁটি গাওয়া ঘি’ এর নামে ঘিয়ের ফ্লেবার মিশিয়ে বাজারজাত করছিল তারা।
বিষয়টি নিশ্চিত করে উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. তানভীর হাসান চৌধুরী বলেন, ভেজাল বিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে। উপজেলায় ভেজাল বিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার চাতরী চৌমুহনী বাজার, বটতলী রুস্তমহাট, বন্দর কমিউনিটি সেন্টার, ভিংরোল ছত্তারহাট, মালঘর বাজার ও আনোয়ারা সদরের জয়কালী হাটসহ বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ দোকানে খুচরা ও পাইকারি দরে ভেজাল ঘি বিক্রি হচ্ছে। ভেজাল ঘিয়ের মধ্যে বিন্টু ঘি, বাঘা বাড়ি ঘি, থ্রি স্টার ঘি, রূপসা ঘি, কর্ণফুলী ঘি, এসপি ঘি, ভিআইপি ঘি, ডানুফা ঘি, এ সেভেন, কুক-মি ঘি, শাহি স্পেশাল গাওয়া ঘিসহ অন্তত ২০টি ভুঁইফোড় ও অবৈধ কোম্পানির ঘি বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে।
ঘি তৈরির সঙ্গে যুক্ত এমন এক কর্মচারীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, উপজেলার বৈরাগ, চাতরী, জুঁইদণ্ডী, বটতলী, শোলকাটাসহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৫-৬টি ভেজাল ঘিয়ের কারখানা আছে। এর বাইরে শহরের বিভিন্ন কারখানা থেকে উৎপাদিত ঘি নগরের পাশাপাশি এ উপজেলার গ্রামীণ হাটবাজারেও সরবরাহ করা হচ্ছে।
ভেজাল ঘি তৈরি করেন এমন একজন কারিগর বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে ছোট্ট কারাখানা বসিয়ে ভেজাল ঘি বানানো হয়। সাধারণত প্রতিটি কৌটায় ৯০০ গ্রাম ঘি থাকে। এ পরিমাণ ঘি তৈরিতে ৬০০ গ্রাম পাম ওয়েল, ২০০ গ্রাম ডালডা ও ১০০ গ্রাম খাঁটি ঘি দেওয়া হয়। এ মিশ্রণে সামান্য পরিমাণে রঙ ব্যবহার করা হয়।
আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.আবু জাহিদ মোহাম্মদ সাইফউদ্দীন বলেন, ‘খাদ্যদ্রব্যে মিশ্রণের খুব ভালো রঙ হলেও সেটি দুই মাসের বেশি কার্যকারিতা হারিয়ে বিষাক্ত হয়ে পড়ে। আর যেহেতু ভেজাল ঘি তৈরি হচ্ছে, তাই সেখানে ভালো রঙ মেশানোর প্রশ্নই আসে না। এ-কারণে এসব ঘি খেয়ে পেটের অসুখ থেকে শুরু করে যকৃতের নানা সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রুস্তমহাটের এক দোকানি জানান, ভালো মানের প্রতি কেজি ঘিয়ের দাম দেড় হাজার থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা। তবে ভেজাল ঘি কেজি প্রতি ৭৫০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব ভেজাল ঘি পাইকারি দরে খুচরা বিক্রেতারা ৪০০-৫০০ টাকায় কেনেন। বেশি লাভ হওয়ায় ভালো মানের ঘিয়ের চেয়ে খারাপ ঘি বিক্রিতেই বেশি উৎসাহ ব্যবসায়ীদের।
বাজারে বিক্রির জন্য রাখা ঘিয়ের কৌটায় দেখা গেছে, সপ্রতিটি কৌটায় ‘১০০ ভাগ খাঁটি ঘি’ বাক্যটি লেখা। সঙ্গে ঘিয়ের নামসংবলিত কাগজে বিএসটিআইয়ের নকল সিল মুদ্রণ করে রাখা হয়েছে। তবে সে কাগজের কোনো কোনোটিতে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লেখা নেই।
জুঁইদন্ডীর থ্রি স্টার গাওয়া ঘি স্বত্বাধিকারী আতারুল করিম বলেন, আমরা রমজানের আগে ঘি তৈরী করে বাজারজাত করে দিয়েছি। বাজারে পাওয়া যাবে ঘি গুলে। এখন আর ঘি তৈরী করব না। তারপরও আমাদের কাগজপত্র বৈধ রয়েছে।
ক্রেতারা বলছেন, অন্যান্য সময়ের তুলনায় পবিত্র মাহে রমজানে ঘিয়ের চাহিদা একটু বেশি থাকে। এজন্য মুদির দোকান, মিষ্টির দোকান ও কুলিং কর্নার গুলোতে সাজিয়ে রাখা হয় বিভিন্ন কোম্পানির ঘি। অবৈধ প্রতিষ্ঠান গুলো নামিদামি কোম্পানির লেবেল নকল করে লাগায়। এতে কোনটি আসল আর কোনটি ভেজাল সেটা বুঝার কোনো সাধ্য থাকে সাধারণ ক্রেতাদের।
বিএসটিআই দপ্তরের আনোয়ারার মাঠকর্মী আবদুল মন্নান বলেন,‘কিছু ভুঁইফোড় অসাধু ব্যবসায়ী আড়ালে থেকে এসব ঘি তৈরি করে বাজারজাত করছে। এর আগে একাধিকবার এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়েছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জোবায়ের আহমেদ জানান, মোড়কে ৯৯.৮০% মিল্ক ফ্যাট ঘোষণা করে আসল ঘি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি হাজার টাকা কিংবা আরো বেশী দামে। অথবা বাবুর্চির সাথে চুক্তি করে যাচ্ছে কমিনিউটি সেন্টারের বড় কোনো প্রোগ্রামে। মূলত বানানো হচ্ছে তেল, ডালডা, খাবার রং এবং আরো অন্যান্য খাবার অযোগ্য জিনিস দিয়ে। তিনি আরো জানান, ঘি মনে করে এ গুলো খেলে রোগব্যাধি তো নিশ্চিত। বৈরাগ ইউনিয়নে এরকম ঘি তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা ভেজাল ঘি কৌটা, পাম অয়েলসহ ক্ষতিকারক রং ও ঘি তৈরির নানা সরঞ্জাম জব্দ ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সংবাদ/জাই