সাতকানিয়ায়- গড়িমসিতে হত্যা মামলা হলেও গ্রেফতার নেই কেউ

শিশু আরোছা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন

 

সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নে অবস্থিত আল কোরআন তাহফিজুল মডেল মাদ্রাসার ছাত্রী নিবাসের বাথরুম থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় আরোছা আক্তার (১১) নামে এক শিশুকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে শিশুটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় মরদেহের সুরতহাল তৈরির পর লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। সে সময় প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল শিশুটি আত্মহত্যা করেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সাতকানিয়া থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা রুজু করা হয়। যার নম্বর ১৫/২৪ (১ মে ২০২৪)। দায়েরকৃত অপমৃত্যু মামলাটির বাদী হয়েছিল নিহত শিশুটির পিতা মো. জিয়াবুল হোসেন।

দীর্ঘ ৫ মাস পর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে মৃত্যুর আসল রহস্য। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী এটি আত্মহত্যা ছিল না, এটি ছিল একটি হত্যাকান্ড। নিহত আরোছা আক্তারের (১১) ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, তাকে মাথায় আঘাত করা হয়েছে। আঘাতের ফলে মাথায় সৃষ্ট ক্ষতস্থান থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে, শিশুটির মৃত্যুর সময় পরিবার বাদী হয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের আসামি করে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের আকুতি জানালে পুলিশ তা গ্রহণ করেননি। এ ছাড়াও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পর সাক্ষীগণসহ থানায় উপস্থিত হয়ে একাধিকবার পুলিশকে অনুরোধ করার পরও নিহত আরোছা আক্তারের মা তৈয়বা আক্তারকে এ মামলার বাদী হতে দেয়নি পুলিশ। নিহতের মা এ মামলায় বাদী হতে পারবেন না জানিয়ে পুলিশ নিজেই বাদী হয়েছেন। যার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে তিনি মামলার বাদী হতে পারবেন না এ কেমন আইন? এমন প্রশ্নের ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, শিশু আরোছা আক্তারের মৃত্যুর ঘটনায় সাতকানিয়া থানার উপ-রিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. নাঈম উদ্দিন গত (২৪ সেপ্টেম্বর) ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে অপমৃত্যু মামলা খারিজপূর্বক অজ্ঞাতনামা বিবাদী বা বিবাদীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলার রুজু করার জন্য সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ বরাবর এজাহার দায়ের করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান (২৪ সেপ্টেম্বর) ৩০২/৩৪ ধারা পেনাল কোড ১৮৬০ অর্থাৎ হত্যা এবং হত্যার কাজের সহায়তা করার অপরাধে অজ্ঞাতনামা আসামি বা আসামিদের বিবাদী করে একটি মামলা রুজু করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান সাতকানিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. মহসিন তালুকদার। বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন আছে বলে জানা গেছে।

 

 

নিহত আরোছা আক্তারের মা তৈয়বা আক্তার কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন মেয়ের বয়স ছিল ১১ বছর। এত ছোট মেয়ে আত্মহত্যা করবে আমরা বিশ্বাস করিনি। প্রথম থেকে আমরা বলে আসছি আমার মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বাথরুমে ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়েছে। ওই সময় আমরা বাদী হয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের আসামি করে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের আকুতি জানালে পুলিশ তা গ্রহণ করেননি।

 

পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত মামলা করা যাবে না। এ ঘটনার ৫ মাস পর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে হত্যাকাণ্ডের সত্যতা বেরিয়ে এসেছে। তবে পুলিশ শুরু থেকেই আমাদেরকে এ বিষয়ে অসহযোগিতা করে আসছে।

 

এ ছাড়াও সাক্ষীগণসহ আমি থানায় উপস্থিত হয়ে পুলিশকে একাধিকবার অনুরোধ করার পরও তারা আমাকে মামলার বাদী না করে পুলিশ নিজেই মামলাটির বাদী হয়ে গেছেন। পুলিশ বলেছে রাষ্ট্র এ মামলার বাদি হবে। আমি পুলিশকে অনেক বুঝিয়েছি যে, আমার মেয়ের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে আমাকে যেন মামলাটির বাদী করা হয়। তারা আমার কোনো কথা কর্ণপাত করেননি। এখন আমার মেয়ের হত্যাকারীদের সঠিক বিচার পাব কিনা এ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

 

 

নিহত শিশুটির পিতা প্রবাসী মো. জিয়াবুল হোসেন জানান, মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে মেয়ের অসুস্থতার কথা অভিহিত করার পর আমরা সাতকানিয়া আলফা হাসপাতালে যায়। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক আমাকে পরামর্শ দেন উন্নত চিকিৎসার জন্য আমার মেয়েকে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যেতে। এজাহারে উল্লেখিত এ কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে খবর দেওয়ার পর আমরা সর্বপ্রথম সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারি আমার মেয়ে মারা গেছে। পুলিশ কেন এজাহারে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য লিপিবদ্ধ করেছে কিছুই তো বুঝতেছিনা।

 

 

নিহত শিশুটির চাচী হুরাইন জান্নাত বলেন, আমার বাবার বাড়ির পাশের একটি মাদ্রাসায় নিহত আরোছা আক্তার নাজেরা বিভাগে অধ্যায়নরত ছিল। ঘটনার দিন আমি আমার বাবার বাড়িতে ছিলাম। সে (আরোছা) তার সমবয়সী চাচাতো বোন অর্থাৎ আমার মেয়ের সাথে আমার বাবার বাড়িতে এসেছিল। আমাদের সাথে বসে সে নাস্তা করার পর সন্ধ্যায় আমার মেয়ে তাকে আবার মাদ্রাসায় দিয়ে আসে। হঠাৎ করে রাত ১০ টার দিকে জানতে পারি সে নাকি আত্মহত্যা করেছে। একটি সুস্থ মেয়ে হাসিমুখে আমার বাবার বাড়ি থেকে মাদ্রাসায় গিয়ে অহেতুক কেন আত্মহত্যা করবে। তখন থেকে আমি সন্দেহ করেছিলাম তার সাথে অন্য কিছু ঘটেছে। ঘটনাটির সঠিক তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনের নিকট দাবি জানাচ্ছি।

 

 

মামলার বাদী উপ-পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. নাঈম উদ্দিন বলেন, অপমৃত্যু মামলা যখন হত্যা মামলায় রূপান্তর হয় তখন রাষ্ট্র বাদী হয়। এটা যদি হত্যা মামলা হতো তাহলে ঘটনার সময় থানায় অপমৃত্যু মামলার পরিবর্তে হত্যা মামলা রুজু হতো। এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা এটা তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে।

 

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. মহসিন তালুকদার বলেন, কে মামলার বাদী হয়েছে সেটি আমার দেখার বিষয় না। আমাকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সনাক্তে আমি কাজ করছি। অপরাধী সনাক্তের পর গ্রেপ্তারপূর্বক আইনের আওতায় আনা হবে।

 

 

সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগটি সঠিক নয়। মামলাটি তদন্তের কাজে আমি নিজে ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত অনেকের সাথে কথা বলেছি। আর নিয়ম অনুযায়ী এই রকম মামলায় পুলিশকে বাদী হতে হয়। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ছাড়া অন্য কেউ বাদী হওয়ার সুযোগ নেই। সর্বোপরি ঘটনার সঠিক কারন উদঘাটনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

 

সূত্র: দৈনিক যায়যায় দিন

২৭শে অক্টোবর ২০২৪

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.