রাঙ্গামাটির আওয়ামী লীগ নেতা রফিক ও তার পুত্র হুন্ডি ব্যবসায়ী জামালের জুলুমে অসহায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবার
হত্যার পর লাশ গুমের হুমকিতে আতঙ্ক! আদালতে মামলা
নিজস্ব প্রতিবেদক
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই চট্টগ্রাম-রাঙামাটিসহ দেশের প্রায় সকল শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন। কেউ কেউ ছাত্রদের হাতে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বাংলাদেশ আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর চলমান অভিযানে গ্রেপ্তার এড়াতে নিরুদ্দেশ রয়েছেন জেলা-উপজেলার শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।
তবে এর মাঝেও ছাত্র-জনতার চোঁখ ফাঁকি দিয়ে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কালো টাকার থাবায় এখনও দুঃসাহসিক কিছু কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতারা।
অনেক নেতা ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি-এনসিপি নেতা কর্মীদের সহযোগীতা নিয়ে এখনও আগের ন্যায় বুক ফুলিয়ে অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম এবং সম্পদ দখলের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে তেমনই একজন দুঃসাহসিক নেতার বিরুদ্ধে। তিনি হলেন রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য রফিক আহম্মদ তালুকদার ও তার পুত্র জামাল উদদীন।
পিতা আওয়ামী লীগ নেতা-পরিচয় এখনও গর্বের সহিত বহন করে বীরদর্পে অপরাধ করে চলেছেন তারই ছেলে মো. জামাল উদ্দিন।
যিনি নিজেকে কখনও ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল, কখনও স্থানীয় লেফট্যানেন্ট জেনারেল এবং শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠজন পরিচয় দিয়ে তাদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার সহজ সরল মানুষদের নিজেদের জিম্মি বানিয়ে রেখেছেন বলে জানান স্থানীয়রা
সম্প্রতি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সম্পদ দখলের অভিযোগ উঠেছে বাপ-ছেলের বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা বাঁধা দিতে গেলেই দিচ্ছেন মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোসহ মারধরের হুমকি। নিজেকে ক্ষমতাধর দাবি করে প্রতিবেদককেও বলেছেন, দেশের সকল প্রশাসনিক সেক্টরেই নাকি তার চেনা-জানা লোক। আর স্থানীয় বিএনপির অনেক নেতাও নাকি তারই কথায় উঠেন-বসেন।
তবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা রফিক আহম্মদ তালুকদার, তার ছেলে হুন্ডি ব্যবসায়ী মো. জামাল উদ্দিন ও তাদেরই ঘনিষ্ঠজন চিকিৎসক সৈয়দ রবিউল হোসেনসহ অজ্ঞাত আরও ৬ থেকে ৭ জনকে আসামি করে আদালতে একটি ফৌজদারী অভিযোগ করেছেন স্থানীয় এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ছেলে মো: ফয়সাল আনোয়ার। আদালতে সি.আর মামলা নং-২৫২/২০২৫-(রাঙ্গুনীয়া থানা)।
গত ১৫ এপ্রিল দুপুরে চট্টগ্রামের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাদী হয়ে অভিযোগটি দায়ের করেছেন, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পূর্ব বেতাগী ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ফরিদ আহম্মেদের ছেলে ফয়সাল আনোয়ার (৩৭)। মামলাটি আমলে নিয়ে যথাযথ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাঙ্গুনিয়া থানাকে নির্দেশ দেন বিচারক।
আদালতে দায়েরকৃত অভিযোগে বাদী উল্লেখ করেছেন, দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখলে থাকা তাদের পারিবারিক জমি অবৈধভাবে নিজেদের দখলে নিতে পাঁয়তারা করছেন উপজেলার পূর্ব বেতাগী ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মিরাজপাড়ার আব্দুল কাদের সুকানীর বাড়ীর মৃত বাচা মিয়া প্রকাশ বাদশা মিয়ার ছেলে রফিক আহম্মদ (৬২) ও তার ছেলে মো. জামাল উদ্দীন (৪২) এবং একই ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের নিয়াজ নতুন বাড়ির মৃত আমির আহম্মদের ছেলে সৈয়দ রবিউল হোসেন (৩৪)সহ সংঘবদ্ধ চক্র।
তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ মার্চ ভোর ৪টার সময় অতর্কিত হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের টিনের ঘর ভাংচুরের চেষ্টা চালায় চক্রটি।
তবে সেদিন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের শোর চিৎকারে এলাকাবাসীরা এগিয়ে এলে তারা পালিয়ে গিয়ে ০১৫– ৮—৯৪ নাম্বারসহ অজ্ঞাত আরও কয়েকটি ফোন থেকে ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে থাকে। ফোনে বলা হয় তাদের বসতভিটাও থাকবে না। পুরো পরিবারকে উচ্ছেদ এবং হত্যা করে লাশ গুম করারও হুমকি দিতে থাকে সংঘবদ্ধ চক্রটি।
সবশেষ গত ১০ এপ্রিল রাত ১২ টায় পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ওপর আক্রমণ চালায় চক্রটি। ওইদিন ৬/৭ জন অজ্ঞাত লোক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার বাড়ির দরজা ভেঙ্গে তারা অবৈধভাবে প্রবেশ করে।
পরে ঘরে থাকা মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ আহমেদের ছেলে ফয়সাল আনোয়ার ও ঘনিষ্ঠজন কামাল হোসেনকে ঘুমন্ত অবস্থায় ফিল্মি স্টাইলে রশি দিয়ে হাত পা বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে বাড়ির বাইরে উঠোনে চুড়ে ফেলে দেন।
এতেই ক্ষান্ত হয়নি। জামালের ভাড়া করা বাহিনী হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় দুজনকে হত্যার উদ্দ্যেশে কিল, ঘুষি ও লাথি মারতে থাকেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
একই সময়ে রফিক আহাম্মদের নির্দেশে তার ছেলে জামাল ও তার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য মুক্তিযোদ্ধার ঘরের চেয়ার, টেবিল, খাট পালং, আলমিরা, ফ্যান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য্য কাপড় চোপড় এবং মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে ভ্যান গাড়ীতে তোলেন।
বাড়ির বাইরের ঘেড়া দেওয়া টিনের বেড়া, টিনের চাল এবং গাছের পিলার, গাছের ছাউনি সব খুলেও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন বলে ফৌজদারী অভিযোগে লিপিবদ্ধ করা হয়।
ভুক্তভোগী ফয়সাল আনোয়ার অভিযোগ করে বলেন, হামলাকারীরা দেশীয় অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত থাকায় আশেপাশের লোকজন ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। তারা চলে যাওয়ার পর প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসেন এবং সেখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
ভুক্তভোগী ফয়সালের দাবি, হামলাকারীরা তার পকেটে থাকা নগদ ৫ হাজার এবং আলমারীতে রক্ষিত থাকা ১০ টাকাসহ ঘরের দামি জিনিসপত্র মিলিয়ে দুই লাখ টাকার জিনিস লুট করেছেন। তাছাড়া ঘরের টিন, কাঠ, পিলার খুলে অন্তত ৫ লাখ টাকার ক্ষতিসাধন করেছেন।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, লুটপাট ও বাড়িঘর ভাঙচুর করেই তারা শান্ত হয়নি। প্রতিনিয়ত অজ্ঞাতনামা ফোন থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে তিনি এবং তার পুরো পরিবারকে। ফোনে বলা হচ্ছে ভিটেমাটি সকল সম্পদ থেকে উচ্ছেদ করা হবে। বাঁধা দিলে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হবে।
পরে উপায়ন্তর না দেখে সামাজিকভাবে সালিশ বিচারের চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের ভয়ে কেউ সাহস করেননি। পরে থানা পুলিশের সহযোগিতা নিতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞ আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করি।
অভিযুক্তরা আরও বেপোরোয়া ও হিংস্র দাবি ভিকটিমের :
আদালতে মামলার পর অভিযুক্তরা আরও বেপোরোয়া ও হিংস্র হয়ে উঠেছেন দাবি করে ফয়সাল আনোয়ার বলেন, বিভিন্ন মাধ্যম প্রতিনিয়ত মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
মামলা তুলে না নিলে তাঁকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া, প্রাণনাশের আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি। এই ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ঘটনাটি অত্যন্ত লজ্জাজনক ও নিন্দনীয় মনে করছেন এলাকাবাসী:
স্থানীয় এলাকাবাসীরা বিষয়টিকে অত্যন্ত লজ্জাজনক ও নিন্দনীয় বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের দাবি, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের প্রতি এমন আচরণ দেশের জন্য অসম্মানজনক। তারা দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
হুন্ডি ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন বলেন-
ফৌজদারী অভিযোগের প্রধান অভিযুক্ত রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য রফিক আহম্মদ তালুকদারের ছেলে মো. জামাল উদ্দিনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, সকল অভিযোগ মিথ্যে, পুরোটা সাজানো। তাদের পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয় করার লক্ষ্যে একটি কুচক্রিমহল উঠে পড়ে লেগেছেন।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগীতায় সাজানো মিথ্যা মামলার আশ্রয় নিয়েছেন আমার চাচাতো ভাই ফয়সাল। মূলত কয়েক বছর আগের পারিবারিক তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমার চাচাতো ভাই আমাদের সম্মানহানীর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে আমার চাচা বেঁচে থাকলে এমন ঘটনা কখনোই ঘটতো না।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তণের সুযোগ নিচ্ছে দাবি আওয়ামী লীগ নেতার:
ফৌজদারী অভিযোগের ২য় অভিযুক্ত রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য রফিক আহমদ তালুকদার বলেন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তণের সুযোগ নিয়ে আমি এবং আমার ছেলের বিরুদ্ধে আদালতে ভিত্তিহীন একটি অভিযোগ করেছেন। যার সাথে আমরা কোন প্রকার সম্পৃক্ত নয়। বিষয়টি তদন্ত করে পুলিশও কোন প্রমাণ পায়নি। ফলে বর্তমানে থানা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ঘটনাটি মিমাংসা হয়ে গেছে।
অভিযোগের বিষয়ে কি বলছে প্রশাসন :
মামলার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা রাঙ্গুনিয়া থানার এস আই (বর্তমানে সন্দ্বীপ থানায় কর্মরত) উত্তম কুমারকে একাধিকবার ফোন করেও তার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
তবে মামলাটির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা রাঙ্গুনিয়া থানার এস আই গোলাম মোস্তাফা জানালেন, তিনি মামলাটির দায়িত্ব গ্রহণ করলেও এখনো তদন্ত শুরু করেন নি। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু করবেন এবং বাদী বিবাধীর সাথে কথা বলে রিপোর্ট দ্রুত পেশ করবেন।
এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এটিএম সিফাত মাজদার কাছেও একাধিকবার ফোন করেও প্রতিবেদকের কল রিসিভ না করায় কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।