একটি দুর্ধর্ষ চুরির রহস্য উদঘাটনের গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক
বেসরকারী চাকুরীজীবী হুমায়ুন মোরশেদ সিদ্দিকী। থাকেন তার নগরের কোতোয়ালী থানাধীন ফিরিঙ্গী বাজার চার্জ রোডস্থ পৈত্রিক বাড়ীর ২য় তলার ফ্ল্যাটে। গেল বছরের আগস্টে এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে তাঁর শশুর বাড়ীতে বেড়াতে গেলে চুরি হয় বাসায় থাকা ৩১ ভরি স্বর্ণ, ৭০ হাজার নগদ টাকা, একটি এবং প্রয়োজনীয় বেশ কিছু কাগজপত্র।
এ ঘটনায় হুমায়ুন বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে এজাহার দায়ের করেন কোতোয়ালি থানায়। মামলা তদন্তের ভার পড়ে একই থানা উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও পাথরঘাটা ফাঁড়ির ইনচার্জ সুকান্ত চৌধুরীর কাঁধে। ক্লু-লেস এই মামলার দায়িত্ব পেয়েই একাধিক সোর্স নিয়োগ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
পুলিশ জানায়, তদন্তের শুরুতে ওই এলাকার ১৫-২০ টি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। তবে আসামিরা পেশাদার চোর হওয়ায় বেশ কৌশলের নিয়েছিলেন। তাদের মুখে ছিল মাস্ক, আর মাথায় ছিল ক্যাপ। ফলে পুলিশ তাদের কোনভাবেই শনাক্ত করতে পারছিলেন না। পরে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে ওই এলাকার ঘটনার সময়ে কথা হওয়া বেশ কিছু সন্দেহভাজন মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করা হয়। সূত্র ধরেই পুলিশ জানতে পারে এই চুরিকাণ্ডে এক সিএনজি চালকের জড়িত থাকার কথা।
তদন্ত কর্মকর্তা জানায়, টানা চার মাস চেষ্টা শেষে সিএনজি চালক মো. মুছাকে (৩৫) গ্রেফতার করা হয় এই বছরের জানুয়ারিতে। তবে চোরাই মালামাল পরিবহনে জড়িত থাকা সিএনজি চালকও অন্যান্য আসামির তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে চুরির সাথে জড়িত আসামির সংখ্যা, তাদের শারীরিক গঠন ও পোষাক সম্পর্কে কিছু তথ্য দেয়। একইসাথে সে জানায় চোরাই মালামাল নিয়ে কর্নফুলী নদীর অভয়মিত্র ঘাটেই গেছিল সে এবং আসামিরা নদী পার হয়েছিল বলে জানায় সে।
এরপর সিএনজি চালককে কারাগারে প্রেরণ করে তার দেওয়া তথ্যে ভর করে আবার ব্যাপক তদন্তে নামে পুলিশ। নদী পার হওয়ার কথা শুনে তদন্ত কর্মকর্তা ধারণা করেন চোরের দলটি কর্ণফুলী থানার বাসিন্দা হতে পারেন। সেই সাথে কর্ণফুলী উপজেলায় ঘুরে বেশ কিছু পেশাদার চোরের নামও সংগ্রহ করা হয়। এরপর নিয়োগ করা হয় আরও একাধিক সোর্স। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) দক্ষিণ জোনের অতিরিক্ত কমিশনার পলাশ কান্তি নাথ ও কোতোয়ালি থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীনের তত্ত্বাবধানে কয়েকদিনের তদন্ত শেষে সোর্সের দেয়া তথ্য ও তদন্তে উঠে আসা প্রমাণের ভিত্তিতে একজনকে শনাক্ত করা হয়।
এসআই সুকান্ত জানায়, শনাক্তকৃত ওই ব্যক্তির একাধিক মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করা হয়। তথ্য প্রযুক্তি সহায়তায় তার কুমিল্লা অবস্থানের তথ্য জানতে পারে পুলিশ। কিন্তু এর একদিন পর সব মোবাইল নাম্বার পাল্টে ফেললে তদন্ত কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। তবে হাল না ছেড়ে শনাক্তকৃত ব্যক্তির নতুন মোবাইল নাম্বারও সংগ্রহ করে পুলিশ। একইসাথে তার নতুন অবস্থান জানতে পেরেই মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) কর্ণফুলী থানাধীন দক্ষিণকূল এলাকায় অভিযান চালিয়ে মো. আব্দুল আজিজকে (৩৩) গ্রেফতার করা হয়। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নিশ্চিত করা হয় চুরির সাথে আজিজের জড়িত থাকার বিষয়টি।
কোতোয়ালি থানা পুলিশ বলেন, গ্রেফতার কৃত আসামি আজিজকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমদিকে সে স্বীকার না করলেও একপর্যায়ে তার সাথে জড়িত আরেক আসামির তথ্য দেয়। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কয়েকঘণ্টার মাথায় আসামি বশির প্রকাশ বাচ্চুকে (৪৮) গ্রেফতার করা হয়। উভয়ের যৌথ জিজ্ঞাসাবাদে আরেক আসামি ও চুরি কার্যক্রমের সহযোগী স্বর্ণকারক সুমন ধরের (৩৬) তথ্য দেয় তারা। পরে নগরের একাধিক স্থানে অভিযান চালিয়ে তাকেও গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত এই তিন আসামিকে তিন দিনের রিমান্ডের আনা হলে আসামি সুমন ধরের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাজারীগলিতে অভিযান চালিয়ে চোরাকৃত স্বর্ণের ২৩ ভরি ওজনের গলিত বারসহ আরেক স্বর্ণকার সুমন সাহাকে (৩৪) বুধবার (১০ জানুয়ারি) গ্রেফতার করা হয়। রিমান্ডে থাকা আসামিরা পেশাদার চোর বলে স্বীকার করে এবং তাদের সাথে একে অপরের পরিচয় হয় কারাগারে থাকতেই। এর আগে চুরির মামলায় তারা বেশ কয়েকবার জেল খেটেছেন বলে জানা গেছে।
আসামির আজিজ ও বশির বলেন, নগরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে কোন বাড়িতে লোক বেড়াতে সেই খবর নেন তারা। তারপর কয়েকদিন বাড়িটি রেকি করে চুরি করে তারা। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রিমান্ডে থাকা এই দুই আসামি  বলেন, ওই বাড়িতে লোক বেড়াতে যাওয়ার কথা জানতে পেরেই বাড়িটি রেকি করে তারা। তারপর রাতে বাড়িটির জানালা কেটে ভেতরে ঢুকে দুইজন এবং একজন বাইরে অবস্থান নেন। বাড়ির ভেতরে মামলার বাদির বেডরুমে থাকা সিন্দুক ভাঙতে না পেরে সেটিসহ নিয়ে আসে তারা।
তারপর একটি সিএনজিযোগে অভয়মিত্র ঘাট হয়ে কর্ণফুলী থানার আজিজের বাড়িতে সিন্দুকটি রাখা হয়। পরের দিন তাদের সাথে কারাগারে পরিচয় হওয়া স্বর্ণকার সুমন ধরকে বাসায় এনে মেশিনের সহায়তায় সিন্দুকটি খোলা হয়। পরবর্তীতে সিন্দুকটি টুকরো টুকরো করে কর্ণফুলি নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। সবশেষে স্বর্ণগুলো হাজারী গলির সুমন সাহার নিকট বিক্রি করে নগদ টাকাসহ আসামিরা ভাগ করে নেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুকান্ত চৌধুরী বলেন, ‘চুরিকাজে অংশ নেওয়া তিন আসামির মধ্যে দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরেক আসামী ওসমান (৩৫) পলাতক আছেন। গ্রেফতারকৃত আসামি আজিজ ও বশির স্বীকারোক্তিতে চুরি কাজের সহযোগী সুমন ধরকে গ্রেফতার করা হয়। তিন আসামিকে তিন দিনের রিমান্ডে আনলে তাদের দেয়া তথ্যে আরেক সহযোগী সুমন সাহাকে গ্রেফতার করা হয়।’
কোতোয়ালি থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন বলেন, ‘থানার এসআই সুকান্ত এবং তার সাথে একাধিক ফোর্স এই দুর্ধর্ষ চুরির রহস্য উদঘাটন ও আসামিদের গ্রেফতারে কাজ করেছে। আমি তাদের ধন্যবাদ জানায়। বর্তমানে তিন আসামি কোতোয়ালি থানায় রিমান্ডে আছে এবং আরেক আসামি সুমন সাহাকে আজকে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।’
মামলার বাদী ও এস.আলম গ্রুপের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন মোরশদ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমার বাসায় চুরির ঘটনার পর পুলিশ আমার সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেছে। তাদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতার কারণে আজকে এই চুরির রহস্য উদঘাটন হয়েছে এবং আসামিরা গ্রেফতার হয়েছে। আমি টিম কোতোয়ালি এবং বিশেষ করে এসআই সুকান্তকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.