নিজস্ব প্রতিবেদক
১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভালবাসা দিবস। সেদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) প্রশাসন ভালবাসা দেখালো নয় শিক্ষকের প্রতি। তাদের তিন জন সাবেক, ছয় জন বর্তমান শিক্ষক। কিন্তু প্রশাসনের এই নয় শিক্ষকের প্রতি ভালবাসা অন্য ৯০২ শিক্ষককে করেছে ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। কারণ উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ শুধুমাত্র নয় শিক্ষককে বিশেষ সুবিধায় করোনা ভ্যাকসিন দিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালক দিয়েছেন চিঠি। এই চিঠিকে ভালবাসা নয়, বৈষম্য বলেই আখ্যা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল শিক্ষক।
শুধু তাই নয়, যাদের এই বিশেষ সুবিধা দিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে রয়েছে গুরুতর অভিযোগ।
তাদের একজন মহামান্য রাষ্টপতিকে ফেসবুকে হেয়প্রতিপন্ন করে লিখে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। আরেকজন বিএনপি-জামায়াতের প্রশাসনের শিবির নিয়ন্ত্রিত আব্দুর রব হলের হাউস টিউটর পদে দায়িত্ব পালনের ‘মুনশিয়ানা’ দেখিয়ে এখন দায়িত্ব পালন করছেন তিনি আওয়ামী লীগের আমলের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আইসিটি সেলের কর্তা হিসেবে। আরেকজনের বিরুদ্ধে উঠেছিল ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে গ্রুপিংয়ের সুস্পষ্ট অভিযোগ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) উপাচার্যের আস্থাভাজন হওয়ায় তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হর্তাকর্তা বলেও গুঞ্জন রটেছে ক্যাম্পাসে। এই গুঞ্জনের আগুনে ঘি ঢাললো এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) এসএম মনিরুল হাসানের একটি চিঠি। যে চিঠি তিনি দিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারের একান্ত ঘনিষ্ঠ নয় শিক্ষককেই করোনা ভ্যাকসিন দিতে এই চিঠি চমেক পরিচালককে দেওয়া হয় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০৭ কর্মরত শিক্ষকের মধ্যে বিতর্কিত তিন জনসহ নয় শিক্ষককেই কেন করোনা ভ্যাকসিন দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ড. শিরীণ আখতারের নেতৃত্বধীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সার্বজনীন পক্ষপাতমূলক নীতি নিয়েও। যেখানে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে করোনা ভ্যাকসিন দিতে রেজিস্ট্রেশন সহজ করে দেওয়ান
হয়েছে সেখানে গুটিকয়েক শিক্ষকের স্বাস্থ্যের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এত সুনজর কেন- সে আলোচনায় চলছে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র। নয় শিক্ষককে সুবিধা পাইয়ে দিতে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত ওই চিঠি হাতে এসেছে চট্টগ্রাম সংবাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে কর্মরত আছেন মোট ৯০৭ শিক্ষক। তাদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ বছর আগে অবসরে যাওয়া চার শিক্ষক এবং বর্তমান অপেক্ষাকৃত পাঁচ জুনিয়র প্রফেসরকে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন, আসমা সিরাজ উদ্দিন ড. আব্দুস ছালামকেও করোনা ভ্যাকসিন দিতে রেজিস্ট্রারের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়। গুঞ্জন আছে, প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারকে উপাচার্য পদ পাইয়ে দিতে ভূমিকা ছিল সাবেক চবি উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিনের।
বর্তমান শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা পরিচালনা ও প্রকাশনা দফতরের পরিচালক ড. আব্দুল্লাহ আল ফারুক, সিন্ডিকেট সদস্য ড. মঈনুল হক মিয়াজী, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রহমান নাসির উদ্দিন, আইসিটি সেলের পরিচালক খায়রুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ও সাবেক প্রক্টর সিরাজ উদ দৌলা ও বর্তমান প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া।
এদের মধ্যে প্রফেসর ড. রহমান নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে হেয়প্রতিপন্ন করে ফেসবুকে লিখালিখির ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী দফতরে দায়ের হয় অভিযোগ। সে অভিযোগ তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ অভিযোগ ওঠার পর বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা পরিচালনা ও প্রকাশনা দফতরের পরিচালক পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন ড. রহমান নাসির উদ্দিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের অভিযোগ, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে কটুক্তি এবং আওয়ামী লীগকে ‘পোল্ট্রী ফার্ম’ আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন সময় ফেসবুকে লিখেছেন ড. রহমান নাসির উদ্দিন। বামপন্থী শিক্ষক হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের কট্টর সমালোচক এই শিক্ষককে ছাত্রলীগ নেতার অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে সবসময় সুবিধা দিয়ে আসছে অনৈতিকভাবে। ইউজিসির তদন্ত কমিটির হাত থেকে তাকে বাঁচাতে উপাচার্য শিরীণ ঢাকা-চট্টগ্রাম অসংখ্যবার দৌড়ঝাপও করেছেন। এতকিছুর পরও উপাচার্য দফতরের প্রতিদিনের নানা আয়োজনের ছবিতে উপাচার্যের পাশেই দেখা যায় ড. রহমান নাসির উদ্দিনকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাগজ-কলমে কোনো দায়িত্ব পালন না করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে এতদিন গুঞ্জন চলে আসলেও বিশেষ সুবিধায় তাকে করোনা ভ্যাকসিন দিতে গিয়ে ওই গুঞ্জনগুলোকেই সত্য বলে প্রমাণ করে দিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শুধু তাই নয়, রহমান নাসির যা বলেন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ড. শিরীণ তা-ই শুনতে বাধ্য বলেও প্রচার আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।’
এদিকে বিশেষ সুবিধায় করোনা ভ্যাকসিনের পেতে প্রশাসন মনোনীত শিক্ষকদের অন্যতম আইসিটি সেলের পরিচালক ড. খায়রুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে দায়িত্ব পালনের অভিযোগ রয়েছে। ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া শপথ নেয়। ওইদিনই চবি আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের নেতা প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ গোলাম কবিরকে আব্দুর রব হলের হাউস টিউটর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক খায়রুল ইসলামকে হাউসটিউটর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিএনপি সরকারের প্রশাসনে দায়িত্বপালনকারী শিক্ষককে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আইসিটি সেলের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে চলছে সমালোচনা।
অন্যদিনে করোনা ভ্যাকসিনের জন্য বিশেষ সুপারিশপ্রাপ্ত ‘সৌভাগ্যবান’ শিক্ষকদের একজন লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌলা। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা।
বিশ্ববিদ্যালয়েরউ প্রক্টর থাকাকালীন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে উঠেছিল ছাত্র হত্যায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ। ছাত্রলীগের মধ্যে গ্রুপিং বাঁধিয়ে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একটি গ্রুপকে নিজের পক্ষে রেখে তাদের শত অন্যায়কে তিনি বৈধতা দিতেন বলেও রয়েছে অভিযোগ। ২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় সিরাজ উদ দৌলাকে ছাত্র উপদেষ্টার পদ থেকে অব্যাহতি দিতে আন্দোলনে নামে ছাত্রলীগ।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর এসএম মনিরুল হাসান বলেন, ‘এই নয় শিক্ষকের জন্য আমরা চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে চিঠি দিয়েছি। তাদের বয়স এবং করোনা ঝুঁকি বিবেচনা করে এ সুপারিশ করা হয়েছে। বাকি শিক্ষকদেরও করোনা টিকা দেওয়া হবে। এ জন্য একটি চিঠি আমরা মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছি।’
রাষ্ট্রপতিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটূক্তির ঘটনায় অভিযুক্ত প্রফেসর ড. রহমান নাসিরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতিকে কটূক্তি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ ইউজিসি তদন্ত করছে। তবে আমরা তদন্তের বিষয়ে কিছু জানিনা।’
এদিকে বিতর্কিত শিক্ষকসহ প্রশাসনপন্থি শিক্ষকদের বিশেষ সুবিধা দিতে চমেক পরিচালককে চিঠি দেওয়াকে অনৈতিক বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, ‘বর্তমান যে ক’জন শিক্ষকের নাম ভ্যাকসিন নিতে চমেকে দেয়া হয়েছে তারা প্রফেসরদের মধ্যে অনেক জুনিয়র। উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় অথচ প্রশাসনের চোখে এই শিক্ষকরা হয়ে গেল সিনিয়র। সবার জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তাদের নোংরা মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। যে শিক্ষকদের ভ্যাকসিনের জন্য প্রশাসন অনৈতিক তদবির করেছে এটি তাদের জন্যও লজ্জাজনক। সহকর্মীদের বাদ দিয়ে তারা প্রশাসন থেকে এ ধরণের বিশেষ সুবিধা নিবেই বা কেন?’
শিক্ষকদের কেউ কেউ প্রশ্ন রাখেন, ‘৯০২ জন শিক্ষকের করোনা ভ্যাকসিন নিশ্চিতের জন্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাঠিয়ে দীর্ঘসূত্রিতায় ফেলে দিয়েছে প্রশাসন। প্রশাসন উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ নয় শিক্ষকের প্রাণ রক্ষায় জরুরি ভ্যাকসিন দিতে চমেক হাসপাতাল পরিচালককে চিঠি দেওয়াটা লজ্জার বিষয়।’