চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২৬ ডিসেম্বর। এই ধাপে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ভোট হয়েছে। আগে থেকে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। আর সেদিন চার ইউনিয়নে এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ১২ প্রার্থী। এছাড়া সাধারণ ও সংরক্ষিত নারী সদস্যের ৭২ পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আরও ২৮৪ প্রার্থী। সব মিলিয়ে মোট ২৯৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, বিজয়ী হন ৭৬ জন।
নির্বাচনে শেষ হতেই বিজয়ী প্রার্থীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি ফুল হাতে ছুটেছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দপ্তরে। ওসির সঙ্গে ফুলেল শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরপরই এসব ছবি দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এসব ছবিতে যেমন অভিনন্দনের জোয়ার তৈরি হয়েছে, তেমনি তৈরি হয়েছে আলোচনা।
পরাজিত প্রার্থীদের কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর প্রার্থীরা ফুলেল শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন জনগণের সঙ্গে। কিন্তু তারা তা না করে পুলিশের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। এর মাধ্যমে জনগণের কাছে ভিন্ন বার্তা যাচ্ছে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও আইনজীবীরা বলছেন, জনগণের রায়ে একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। তারা অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি। বিষয়টি জনপ্রতিনিধিদের নিজেদেরই উপলব্ধি করতে হবে। বিজয়ী হয়ে একজন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে ওসির শুভেচ্ছা বিনিময় গণতন্ত্রের জন্য ভালো বার্তা বহন করে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত রোববার (২৬ ডিসেম্বর) নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন সময় ওসির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে ফেসবুকে ছবি দিয়েছেন- চুনতি ইউনিয়ন থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন জনু, পদুয়া ইউনিয়ন থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান হারুনর রশিদ এবং একই ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত মেম্বার শহিদুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত মেম্বার শাব্বির আহামদ।
এছাড়া শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন চরম্বা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত মেম্বার মো. সোলাইমান, ৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত মেম্বার জয়নাল আবেদিন, কলাউজান ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত মেম্বার মো. আইয়ুব এবং বড়হাতিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত মেম্বার রফিক উদ্দিনসহ অনেকেই।
পুলিশকে ফুল দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে চুনতি ইউনিয়ন থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন জনু বলেন, ‘পুলিশ আমাদের এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে, এজন্য শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। আমার এলাকা থেকে আসামি ধরলে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তাছাড়া আমি নির্বাচিত হওয়ার পরেই তো গেছি, আগে যাইনি।’
তিনি বলেন, ‘আমি জনগণের ভোটেই নির্বাচিত হয়েছি। অনেকে অনেক কথা বলবে। এত কথা শোনার সুযোগ নেই।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির সুজন বলেন, ‘রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানের যোগ্য হচ্ছেন নাগরিকরা। সেই নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত হন জনপ্রতিনিধি। আমাদের সমাজে এখন জনপ্রতিনিধিরা মাথা নোয়াচ্ছেন পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে। এটি মোটেও সুখকর বিষয় না, বরঞ্চ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। নির্বাচিত ব্যক্তিরা ওসিকে ফুল দিয়ে ভুল করেছেন। তাছাড়া ওসি সাহেবেরও উচিৎ ছিল তাদের থামিয়ে দেওয়া। যদি ওসি সাহেব উৎসাহের সঙ্গে এসব কাজ করে থাকেন তবে, এসপি সাহেবের উচিৎ ছিল তার কর্মকাণ্ডে লাগাম টানা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমনিতে গত কয়েক দশক থেকে নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ওসির সঙ্গে ফুল বিনিময়ের মতো কাজ নির্বাচনকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমরা আশা করবো, জনপ্রতিনিধিরা ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সতর্ক হবেন।’
জানতে চাইলে লোহাগাড়া থানার ওসি জাকের হোসাইন মাহমুদ বলেন, ‘আমাকে কেন ফুল দিয়েছেন, যারা দিয়েছেন তাদের কাছ থেকে জেনে নেন।’
সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শিবলী নোমান বলেন, ‘লোহাগাড়ায় সুষ্ঠু ভোট হয়েছে, যেটি আপনারা সবাই দেখেছেন। ভোট নিয়ে এ পর্যন্ত কেউ অভিযোগ দেননি। ভোটের পর হয়তো বিজয়ী প্রার্থীরা ফুল নিয়ে আসছেন। এটাতে তেমন কোনো সমস্যা দেখছি না।’
জানা গেছে, রোববার কর্ণফুলী উপজেলার চারটি, পটিয়ার ১৭টি এবং লোহাগাড়ার ছয়টিসহ চট্টগ্রাম জেলার মোট ২৭ ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২১টিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও ছয়টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় লাভ করেন।