স্মরণীয় যুগে পা রাখলো চট্টগ্রাম বন্দর

১৩৫ বছর পর বড় জাহাজ ভেড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। আজ সোমবার (১৬ জানুয়ারি) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্দর জেটিতে নোঙর করছে ১০ মিটার গভীরতা ও ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের বড় জাহাজ। এরমধ্যে দিয়ে আজ শুরু হলো ‘চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য স্মরণীয় এক যুগ’ বলে মন্তব্য করেছেন বন্দরের সিসিটি-১ জেটিতে বড় জাহাজ বার্থিং এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের উপস্থিত বক্তারা।

অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, গত বছর আমরা ৩০ লাখ ১০ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করছি। কাজেই আমরা ত্রি মিলিয়ন কনটেইনার ক্লাবে অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছি। আজ সিসিটি জেটিতে মার্শাল আইল্যান্ডসের পতাকাবাহী জাহাজ দিয়ে ১৯৯ দশমিক ৯ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো শুরু হল। বন্দর ব্যবহারকারী ও দেশকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে আমরা আজ সক্ষম। বাংলাদেশের জাহাজ মালিকরা বড় বড় জাহাজ নিয়ে আসছেন। আমরা জাহাজগুলো ভেড়াতে সক্ষমতা অর্জন করেছি।

বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, বন্দরে ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ বার্থিং এর উদ্বোধন হয়েছে। আজ চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ঐতিহাসিক মুহুর্ত। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আরো বেড়ে গেল। বঙ্গবন্ধু বন্দরকে মাইনমুক্ত করে চালু করেছিলেন। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী সমুদ্রসীমা জয় করেছেন। করোনার মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর একমুহূর্তও বন্ধ ছিল না। সব কৃতিত্বের মূল দাবিদার আমাদের শ্রমিকরা। করোনার মধ্যে তাদের মুখে ‘না’ শব্দ শুনিনি। তাই আমরা প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। এর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।

তিনি আরো বলেন, বে-টার্মিনাল জাতির চাহিদা। বে-টার্মিনাল এর নকশাসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হয়ে গেছে। ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে। জেনারেল কার্গো হ্যান্ডলিং ও জাহাজের পরিমাণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। করোনার সময়ও বিজিএমইএ রপ্তানি চালিয়ে গিয়েছিল। বিজিএমইএ, বিকেএমইএ সকলের সহযোগিতায় আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা সবাইকে নিয়ে আরো এগিয়ে যাবো।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, করোনাকালে চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৪ জন লোক মারা গেছে অথচ বন্দর বন্ধ হয় নাই। চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যাপারে সরকার, সংসদীয় কমিটির একটা বিশেষ নজর আছে। কাজেই এটাকে কাজে লাগাতে হবে। এক এক দেশের অর্থনীতির ধারা এক এক রকম। এটা সরকারের জন্য শেষ বছর। এই সময়টাতে বিভিন্ন দল বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চায়। কাজেই কোন উষ্কানি কানে নেয়া যাবে না। পদ্মা সেতু দেশের জন্য হয়েছে। তাই সবদিক দিয়ে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে। তাই এনালগ পদ্ধতিতে বন্দর চলতে পারে না। কাজেই আপনাদেরকেও প্রযুক্তিগত দিক থেকে প্রস্তুত হতে হবে। এভাবেই কাজ করতে হবে।

ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার এইচ ই রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, বড় জাহাজ ভিড়লে অনেক বেশি কনটেইনার আসবে। কাজেই বিনিয়োগও বাড়বে। আমি খুব আনন্দিত বন্দরের এমন অর্জনে। আমার দেশের একটি কনসালটেন্ট গবেষণা কাজে জড়িত ছিল তাই আমি আনন্দিত।

লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘এইচআর ওয়েলিং ফোর্ড’ এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. মনজুরুল হক বলেন, আমাদের এ গবেষণাটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। পাশাপাশি করোনার সময় গবেষণা কাজ চালিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন ছিল। ২০২০ সালের নভেম্বরে গবেষণার জন্য বন্দরের সাথে চুক্তি হয়। আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে দুই বছর সময় লেগেছে। তবে আজ আমরা সবাই মিলে সফল হয়েছি। এটাই ভাল লাগছে।

শিপিং এজেন্ট এসোশিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. আরিফ বলেন, ১৯৭৫ সালে যেখানে ১৬০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভিড়তো আজ সেখানে ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভিড়ছে। এতদিন জাহাজে করে ২ থেকে আড়াই হাজার টিইইউএস কনটেইনার আসতো। এখন আরো বেশি কনটেইনার পরিবহন করা যাবে। বর্তমানে ৩ হাজারের বেশি কনটেইনার ও ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন মালামাল নিয়ে আসতে পারবে। নদীর গভীরতা বাড়াতে পারলে ভবিষ্যতে ২২৫ মিটার দৈর্ঘের জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। সিসিটি জেটিতে এক সময় একটা জাহাজ ঢুকতো। এখন জাহাজ চলাচল বাড়বে। বন্দরের ২ থেকে ৮ নম্বর জেটিতে ৮ দশমিক ৫ মিটার গভীরতার জাহাজ চলাচল করছে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল চালু হচ্ছে। সেখানেও জাহাজ ভিড়বে। তবে আমাদেরকে কনটেইনার জাহাজের পাশাপাশি বাল্ক জাহাজগুলোর উপর নজর দিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, গতবার ২ লাখ মেট্রিক টন রপ্তানি হয়েছিল। এর আগের বার ৪ লাখ ছিল। তবে জুট রপ্তানি কমে গেছে। যত বেশি রপ্তানি বাড়ানো যাবে সেটা দেশ তথা সবার জন্য ভাল হবে। বন্দরকে আরো গতিশীল করতে চাইলে বন্দর থেকে এফসিএল ও এলসিএল কনটেইনার খালাস হয়। এরকম পৃথিবীর কোন বন্দরে হয় না। এফসিএল ও এলসিএল কনটেইনার হ্যান্ডলিং যদি অফ ডকের হাতে চলে যায় তাহলে আরো বেশি জাহাজ চলাচল করতে পারবে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আজ চট্টগ্রাম বন্দরের স্মরণীয় যুগ। চট্টগ্রাম বন্দর ৯০ এর দশকের আগে খারাপ সময় কাটিয়েছে। অথচ ২০০৯ সালের পরে গত ১৪ বছর এক ঘণ্টার জন্য বন্দর কার্যক্রম বন্ধ হয় নাই। সিসিটি-১ জেটি বানানোর পর চার বছর বন্ধ ছিল। এখন পুরোদমে চালু হয়েছে। আমরা আশা করি বন্দর সামনে ৪০ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারবে। এখন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালটি চালু করা প্রয়োজন। এতে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবে। পাশাপাশি আমি মনে করি কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং করাটা চালু রাখতে হবে। কারণ কর্ণফুলী শেষ মানে দেশের অর্থনীতিও শেষ। পাশাপাশি বে-টার্মিনালের কাজ পুরোদমে চালু করে দিতে হবে। এর বিকল্প নাই। এটি চালু হলে আগামী ৫০ বছর নতুন করে আর টার্মিনালের চিন্তা করতে হবে না। মিরসরাই ইকোনমিক জোন হচ্ছে। সেটার সাথে বন্দরের একটা কানেক্টিভিটি প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.