২৭ বছর ধরে নদীতে বসবাস

প্রায় ২৭ বছর আগের কথা। পাবনার বেড়া উপজেলার কৈটোলা গ্রামের সিরাজুল ইসলাম তখন টগবগে যুবক। বেশ পরিশ্রম করতে পারতেন। সকাল-সন্ধ্যা গ্রামে গ্রামে ঘুরে অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র বিক্রি করতেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সচ্ছলভাবেই চলছিল তাঁর সংসার। কিন্তু হঠাৎ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাঁটুতে পচন ধরে। দুটো পা-ই কেটে ফেলতে হয় তাঁর।

চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়া সিরাজুল হারিয়ে ফেলেন নিজের উপার্জনের উপায়ও। শৌচাগারে যাওয়া, গোসল করা নিয়ে পড়েন বিপাকে। একসময় নিজেকে পরিবারের বোঝা ভাবা শুরু করেন তিনি। ফলে কিছুটা অভিমান আর কিছুটা সুবিধা হবে ভেবে বসবাস করা শুরু করেন বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কাগেশ্বরী নদীর ওপর থাকা নৌকায়। বেশ ক বছর নৌকার ছাউনিঘরে থাকার পর এখন তিনি প্লাস্টিকের ড্রাম দিয়ে তৈরি ছোট একটি ভাসমান ঘরে থাকেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে থাকেন স্ত্রী জয়নব খাতুন। ঝড়বৃষ্টি, দুর্যোগ উপেক্ষা করে নদীর বুকে ২৭ বছর ধরে আছেন সিরাজুল।

সিরাজুল ইসলামের বয়স এখন ৬০-এর কিছুটা বেশি। তিন ছেলে ও চার মেয়ে আছে তাঁর। ভাসমান ঘরের কাছেই কাগেশ্বরী নদীর পাড়ে তিন শতাংশ জমিতে বাস করেন তাঁর ছেলেরা। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। মা-বাবার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেননি তাঁরা। ফলে স্ত্রীসহ নিজের খরচ চালাতে সিরাজুল কখনো মাছ ধরেন, আবার কখনো নৌকার মাঝি হিসেবে কাজ করেন। এতে খুব একটা আয় হয় না। তবে এলাকার লোকজন তাঁকে বেশ সহায়তা করেন। এ ছাড়া সরকার থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পান। ফলে সব মিলিয়ে কোনোরকমে দিন কাটছে তাঁদের।

সিরাজুল বলেন, পা কেটে ফেলার পর যখন নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে হচ্ছিল, তখন থেকে কাগেশ্বরী নদীর স্লুইসগেট এলাকায় খেয়া নৌকার মাঝি হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এতে মোটামুটি আয় হতে থাকে। তা দিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের ভরণপোষণ করতেন। একসময় ঘরবাড়ি ছেড়ে নদীতে নৌকার ওপর বাস করতে শুরু করেন তিনি। একসময় ওই এলাকায় খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর শরীরও অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। নৌকায় বসবাস শুরুর দু-তিন বছর পর তাঁর স্ত্রীও তাঁর সঙ্গে নৌকায় বাস করা শুরু করেন।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘দুই পা হারায়া বাড়ি আসার পর বুঝি সংসারে আমি এখন বোঝা। তারপর থিক্যাই গাঙে বাস কইর‍্যা আসতেছি। এ জন্য ছেলে-মেয়েদের কুনু দোষ দেই না। কারণ ওগরেই তো ঠিকমতো সংসার চলে না। তবে আমার পা দুইখান গেলেও হাত দুই খান তো আছে। দুই হাতে যত দিন শক্তি আছে, তত দিন বইঠা বায়া আর মাছ মাইর‍্যা কুনুরকমে চলব্যার পারব আশা করি।

কাগেশ্বরী নদীতে নৌকায় ও ভাসমান ঘরে পাবনার বেড়া উপজেলার সিরাজুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী জয়নব খাতুনের বসবাসছবি: প্রথম আলো

সিরাজুলের বড় ছেলে সেলিম হোসেন ও মেজ ছেলে জহুরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা সাধ্যমতো তাঁদের বাবাকে দেখাশোনা করেন। তবে আয় কম হওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মা-বাবার পুরো দায়িত্ব নিতে পারেন না তাঁরা।

সম্প্রতি কাগেশ্বরী নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, প্লাস্টিকের আটটি ড্রাম দিয়ে বানানো ভাসমান ঘরে বসে আছেন সিরাজুল ইসলাম। পাশেই ছিল তাঁর ডিঙি নৌকা। এ নৌকায় করে তিনি কখনো মাছ ধরেন, আবার কখনো কেউ পার হতে চাইলে নদী পার করে দেন। এলাকার লোকজন প্লাস্টিকের ড্রামগুলো দিয়েছেন। এ ছাড়া ড্রামের ওপর বানানো ঝুপড়িঘরটি বানানোর ব্যাপারেও এলাকাবাসী সহায়তা করেছেন।

সিরাজুলের স্ত্রী জয়নব খাতুন বলেন, ঝড়বৃষ্টিতে নদীতে থাকা খুব কষ্টের।

স্থানীয় কৈটোলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহসীন উদ্দিন বলেন, ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি সিরাজুলকে নদীতে থাকতে দেখছেন। সামর্থ্য অনুযায়ী তিনি সিরাজুলকে সহায়তা করছেন। আশ্রয়ণের ঘর বরাদ্দের প্রকল্প এলে তাঁকে দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহা. সবুর আলী প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.