হঠাৎ তোপের মুখে ইউএনও, নেপথ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্ত:কোন্দল

সাতকানিয়ায় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে টানাহেঁচড়া ঘটনা

সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা

সাতকানিয়ায় স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আলোচনা সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের নগদ টাকার পরিবর্তে ইফতারসামগ্রী এবং উপজেলার প্রাক্তন কমান্ডার এমএমজি আবু তাহেরের দেওয়া তালিকার বাইরে সরকারি ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেওয়াকে কেন্দ্র করে উপজেলার একাংশের মুক্তিযোদ্ধাদের তোপের মুখে পড়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা-তুজ-জোহরা।

 

 

লোহাগাড়া উপজেলা প্রশাসনের ছবি

রবিবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ হল রুমে এ ঘটনা ঘটে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলা পরিষদের সামনে তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ সমাবেশ করে ইউএনও’র বিরুদ্ধে বিহীত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ও আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

 

অন্যান্য উপজেলার অনুষ্ঠারের রেফারেন্স টেনে সাতকানিয়া উপজেলা প্রশাসনকর্তৃক দেয়া ছবি

 

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, আজ রবিবার সকালে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যেগে উপজেলা পরিষদ হল রুমে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ মোতালেব প্রধান অতিথি ও ইউএনও সভাপতিত্ব করেন। এ সময় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দীন হাসান চৌধুরী, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আনজুমান আরা বেগম, উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) আরাফাত সিদ্দিকী ও থানার ওসি ইয়াসির আরাফাত উপস্থিত ছিলেন। সভাপতির বক্তব্য শেষে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি প্রদান পর্ব। এর অংশ হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও এবং অন্যান্য অতিথিরা ইফতার সামগ্রীসহ একটি প্যাকেট মুক্তিযোদ্ধাদের প্রদান করছেন।

 

পার্শবর্তী উপজেলা চন্দনাইশের ছবি

এ সময় হল রুমে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ডালু ব্যানারে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু লেখা ও বঙ্গবন্ধুর ছবি না থাকায় প্রতিবাদ করেন। পরে একইভাবে সাতকানিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার আবু তাহের এলএমজিও একই কথার রেশ টেনে প্রতিবাদ শুরু করেন।

 

 

এতে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও সমস্বরে প্রতিবাদ করতে থাকেন। এর মধ্যে অনুষ্ঠানে আসা কিছু মুক্তিযোদ্ধা উপহার সামগ্রী নিতে চাইলে তাদের টেনে-হেছড়ে হল রুমের ডায়াস থেকে নামিয়ে দেয় এলএমজি আবু তাহের সমর্থক নুরুল ইসলাম, অরুন, হুমায়ুনরা। এক পর্যায়ে শার্টের কলার ধরে বীরমুক্তিযোদ্ধা সুবেদার মোনাফ, সিরাজকে অপমান অপদস্থ করা হয় বলে এমন অভিযোগ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জন আবু তাহের।

এ সময় সার্জেন্ট আবু তাহের ও এমএলজি সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হাতাহাতি ও তুমুল হট্টগোল শুরু হয়।

 

পরে উপস্থিত থানার ওসি ইয়াসির আরাফাতসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা তাদের নিবৃত্ত করেন এমন একটি ভিডিও ফুটেজ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

এর মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান হট্টগোল নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। পরে তিনি সভাস্থল ছেড়ে যান। পরে ইউএনও পরিস্থিতি শান্ত হলে আনসার বেস্টনির মধ্য দিয়ে সরকারি গাড়িতে করে সভাস্থল ত্যাগ করেন।

এর মধ্যে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া উপহার সামগ্রী হাতে নিয়ে হল রুম থেকে বের হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে চরম হেনস্তা করেন। পরে প্যাকেট খুললে দেখা যায়, সেখানে ৭-৮ পদের ইফতার সামগ্রী রয়েছে। তবে ইফতার সামগ্রীরমূল্য ১৫০০টাকা বলে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা প্রশাসন।

পরে মুক্তিযোদ্ধারা হল রুম থেকে বের হয়ে উপজেলা পরিষদ ভবনের সামনে ইউএনও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন আবু তাহের এলএমজি। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা মিলন কুমার ভট্টাচার্য্য ও মুক্তিযোদ্ধা অরুন মজুমদারসহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন।

আবু তাহের এলএমজি বলেন, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের ব্যানারে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু না লিখে ইউএনও যে বিএনপি-জামায়াতের চেতনাকে ধারন করেন সে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি ছাড়া ব্যানার ছাপিয়ে স্বাধীনতার দিবসের অনুষ্ঠান করা চরম দৃষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর বিহীত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ দলীয় হাই কমান্ডের হস্তক্ষেপ চাই। বক্তব্যে আবু তাহের আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান স্বরূপ প্রতি বছর যাতায়াত ভাড়া বাবদ কিছু সম্মানী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হতো। অথচ এবছর তা না দিয়ে রিলিফের সামগ্রী দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করলে তার ফান্ড নাই বলে আমাদের জানান। অথচ এ অনুষ্ঠানের নাম দিয়ে তিনি লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করেছেন।

 

সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইয়াসির আরাফাত বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হট্টগোল শুরু হলে আমি ও পুলিশ সদস্যরা মিলে তাদের নিবৃত্ত করি। ফলে বড় কোন ঘটনা হয়নি।

 

 

ইউএনও ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, ব্যানারে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু লেখার সরকারি পর্যায়ে বাধ্যবাধকতা নেই। ব্যানারটি আমন্ত্রন কার্ডে যে ষ্টাইল রয়েছে সেভাবেই লেখা হয়েছে। তবে বক্তব্যের সময় জয় বাংলা বলা বাধ্যতামূলক। হট্টগোলের বিষয়ে ইউএনও বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপহার সামগ্রী নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। এতে আবু তাহের সাহেবের লোকেরা সম্মানী নেওয়াদের উপর চঁড়াও হয়ে উপহার নিতে বাধা দেয়। লাখ লাখ চাঁদা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে ইউএনও বলেন, এ রকম কোন গ্রুপ দেখাতে পারলে আমার ব্যাখ্যা দিতে কোন সমস্যা নেই। তিনি আরো বলেন মূলত উপহারসামগ্রীর বদৌলতে নগদ টাকা এলএমজি আবু তাহেরের ভাষায় পকেটমানি দাবী করেন, সেটা মূলত সুন্দর না হওয়ায় ঈদ উপলক্ষে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উপহারসামগ্রী প্রদান করাকে আমি যৌক্তিক মনে করেছি।
এদিকে আবু তাহের সাহেবের সমর্থক ব্যতিত অন্য কোন মুক্তিযোদ্ধাদেরও উপহার সামগ্রী নিতে দিবেননা বলে অনুষ্ঠানের ডায়েসের সামনে এসে প্রকাশ্যে হুমকি প্রদান করেন যেসময় পুলিশ প্রশাসনও উপজেলা চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন।
মূলত তাদের নগদ টাকা আর মুক্তিযোদ্ধা অমুক্তিযোদ্ধা নিয়ে রেষ চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে সেখানে উপজেলা প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ঠিক হয়নি।

তিনি আরো যোগ করেন অথচ!এলএমজি আবু তাহের নিজেও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উপজেলা প্রশাসনের উপহারসামগ্রী গ্রহণ করেছেন।নএদিকে ব্যানারে জাতীরজনকও প্রধানমন্ত্রীর ছবি না থাকার বিষয়ে তিনি সরাসরি বলেন- আমাদের অনুষ্ঠানের মূল প্রবেশ পথে জাতীর জনক এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি লাগিয়ে গেইট সাজানো হয়েছে আর অনুষ্ঠানের ব্যানারে যে ছবিও নাম লাগাতে হবে তার কোন নির্দিষ্ট পরিপত্র নেই।
আর আপনি চন্দনাইশ, পটিয়া, আনোয়ারাসহ দেশের অন্যান্য উপজেলায় দেখেন,কোথাও তারা তাদের আমন্ত্রন কার্ডের ডিজাইন ছাড়া আর কারো ছবি লাগায়নি শুধু কেন আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে?

 

এদিকে উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন-সমগ্র বাংলাদেশে কোন ডিজাইনের ব্যানার হবে তা উপরস্থ দফতর কর্তৃক নির্ধারিত,এখানে ব্যানার প্রশ্ন তোললে হাস্যকর ছাড়া আর কিছু নয়।

এদিকে ইউএনও ফাতেমা তুজ জোহরা আরেক প্রসঙ্গে বলেন-যারা উপহারসামগ্রী নিলো তাদেরকে এলএমজি আবু তাহেরদের হেনস্থা থেকে বাঁচার জন্য পুলিশ প্রহরায় অনুষ্ঠান থেকে বের করা হলো যাতে উপহারসামগ্রী নেয়া বীরমুক্তিযোদ্ধারা অপমানিত না হয়।
এবং একই ইস্যুতে এক সাংবাদিকও তাদের দ্বারা অপমানও অপদস্থ হয়।

সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ মোতালেব বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি ইউএনওকে জিজ্ঞাসা করেছি। ব্যানারে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু লেখার বাধ্যবাধকতা নেই বলে জানিয়েছেন। এছাড়া হট্টগোল থামার পর আমি সভাস্থল ছেড়ে অন্য কাজে চলে যায়।

এদিকে বীরমুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট আবু তাহের মুঠোফোনে বলেন- আজকের মহান এই দিবসে আমরা নিরীহ মুক্তিযোদ্ধাদের উপর এলএমজি আবু তাহের সমর্থকরা যেটা করেছেন তা মোটেও কাম্য নয়,আমরা এটার তীব্র প্রতিবাদ জানাই, তিনি আরো বলেন এলএমজি আবু তাহেররা উপহারসামগ্রী নিলে নিবেন না নিলে নেই তবে আমাদেরকে বাঁধা দেয়ার অধিকার তার নেই তা আগামি কমান্ড নির্বাচনে সাতকানিয়া উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাগণ ব্যালটের মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দিবেন।

 

এদিকে প্রতিবেদকে হাতে আসা একটি ২২সেকেন্ডের ভিডিওতে সাতকানিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধাদের আসা যাওয়া পকেট মানি বাবদ ৫০০টাকা কেন দেয়া হলনা বলেও আক্ষেপ করতে শোনা যায়। আরেকটি ভিডিওতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকাশ্যে হাতাহাতি করতেও দেখা যায় যা প্রতিবেদকের হাতে সংরক্ষিত আছে।

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.