বহিরাগত এনে ৮-১০ জন সাবেক ছাত্রনেতার এ কেমন প্রক্টর বিরোধী মানববন্ধন?

যার গোটা পরিবারই আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রত্যক্ষভআবে যুক্ত তাকে শিবির বানাতে এবার মানববন্ধনের আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কয়েকজন ছাত্রনেতা।

ঢাকঢোল পিটিয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের এনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদারের বিরুদ্ধে এ মানববন্ধন আয়োজনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল শুক্রবার গভীর রাতে। সাবেক এক দপ্তর সম্পাদক স্বাক্ষরিত সাদা কাগজের চিঠি লিখে শনিবার (৯ এপ্রিল) মানববন্ধনের সংবাদ কাভারের চিঠিও দেওয়া হয়।

কিন্তু দিনশেষে ৭-৮ জন সাবেক নেতাই কেবল হাজির হলেন এই মানবন্ধনে। এদের মধ্যে সভাপতিত্ব করেন মানববন্ধনের আহবায়ক ও সাবেক চবি ছাত্রলীগ সভাপতি মাহবুব এলাহী ও সঞ্চালনায় ছিলেন সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজন। এ দুইজন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ছাড়া আর কোনো এমন শীর্ষ পদে থাকা সাবেক নেতাকে এই মানববন্ধনে দেখা যায়নি।

উপস্থিত সাবেক নেতাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আমিনুল ইসলাম সুমন, সাবেক উপ দপ্তর সম্পাদক তারেকুল আলম প্রকাশ ভাগিনা তারেক, সাবেক প্রচার সম্পাদক নাজমুল আলম ইমন, সাবেক সহ সভাপতি সাইফুদ্দিন খালেদ, সাবেক সহ সভাপতি মো. ইউসুফ (সাবেক সহকারী প্রক্টর মো. ইয়াকুবের বড় ভাই), সাবেক যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল হাসান নগেন। সাবেক সদস্য মাহবুবুর রহমান ও তানভীর এলাহীও (সম্পাদকীয় পদধারী) ছিলেন এই মানববন্ধনে। এছাড়া পদহীন দুয়েকজন ‘বন্ধু ছাত্রলীগকেও’ দেখা গেছে এই মানববন্ধনে।

 

 

 

এছাড়া ১০-১৫ ছিলেন বহিরাগত। যাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ও প্রক্টরের ছবি। ওই ছবিগুলো ছিল লাল কালিতে ক্রস এঁকে দেওয়া। মানববন্ধনে বহিরাগতদের মাধ্যমে উপাচার্য ও প্রক্টরের মানহানিকর ছবি প্রদর্শনীকে অত্যন্ত আপত্তিকর ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বলেই মনে করছে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের আমলেই তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ঘনিষ্ঠ আওয়ামী পরিবারের সন্তান নুরুল আজিম সিকদারের চাকরি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১১ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের একমাত্র সংগঠন হলুদ দলের সক্রিয় সদস্য নুরুল আজিম সিকদার। তিনি যখন শিক্ষক পদে যোগদান করলেন, তখন এই সাবেক ছাত্রনেতারা কেন প্রতিবাদ করেননি, কেম তারা সেসময় যারা ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তাদের জানাননি? এমনকি প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাস পার হলেও নুরুল আজিম সিকদারের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ তারা উপস্থাপন করতে পারেননি। প্রমাণ ছাড়াই কোনো শিক্ষককে শিবির তকমা দিয়ে রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার নেপথ্যে হয় বড় ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত।

তারা আর বলেন, বহিরাগতদের ভাড়ায় এনে ব্যানার ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে কাউকে শিবির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। আওয়ামী লীগ একটি আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সংগঠন। এই সংগঠনের কোনো মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে নেই, এই সংগঠন রাজনীতি করে সত্যের উপর দাঁড়িয়ে। ছাত্রলীগের গুটিকয়েক পদধারী নেতা কি উদ্দেশ্যে, কার এজেন্ডা বাস্ততবায়নের উদ্দেশ্যে ফেসবুকে কুরুচিপূর্ণ বিষোদগার চালানো, কথিত বিবৃতি প্রদান ও বহিরাগত লোক ভাড়া করে এনে মানববন্ধন করছে। দুয়েক জন ছাত্রলীগ নেতার এমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগের বেশিরভাগ সাবেক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। তারা ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে স্পষ্ট করেই বলেছেন, তাদের সঙ্গে আলাপ না করেই বিবৃতিতে নাম সংযোজন করে দিয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে পদত্যাগকারী কয়েকজন অর্থায়ন করছে বলেও ধারণা করছে।

সাবেক একাধিক ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, তাদের ‘মতলব’ আসলে কি তা-ই এখন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের অনেকটা জানা হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষক হওয়া থেকে শুরু করে সহযোগী অধ্যাপক হওয়া পর্যন্ত আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের একমাত্র সংগঠন হলুদ দলের সক্রিয় সদস্য নুরুল আজিম সিকদারকে হঠাৎ শিবির তকমা জুড়ে দেওয়ার পেছনে কেবল ব্যক্তিস্বার্থই জড়িত, এখানে আদর্শিক কোনো বিষয় নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি ও মেরিন সায়েন্সের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আকরাম রাসেল ফেসবুকে দাবি করেছেন, ৯০ দশকে তার উপর হামলার ঘটনায় নুরুল আজিম সিকদার জড়িত ছিল। এই কথা সত্য হলে, ২০১১ সালে যখন এই বিভাগে নুরুল আজিম সিকদার প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে তখন কেন আকরাম রাসেল প্রতিবাদ করেনি? আকরাম রাসেল তখন কেন ২০১১ সালে যারা ছাত্রলীগের দায়িত্বে ছিল তাদের এ বিষয় অবহিত করেনি? প্রশাসনকেও কেন অবহিত করেনি? আদালতেও তিনি কোনো মামলা করতে পারেননি তার উপর হামলার ঘটনায়? ১৩ বছর পর এসে কেন তার এই প্রতিবাদ? এই প্রতিবাদ কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়?

সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, তাদের কাউকে পদত্যাগকারীরা অর্থায়ন করছে কি-না সেটাও খতিয়ে দেখা জরুরি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়য়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একমাত্র সংগঠন হলুদ দলের সদস্য নুরুল আজিম সিকদার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৫—১৯৯৬ সেশনের শিক্ষার্থী।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে, প্রক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহবুব এলাহী তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে নুরুল আজিম সিকদারকে শিবির কর্মী আখ্যা দিয়ে পোস্ট দেন। মাহবুব এলাহীর এই পোস্ট ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজনকে ফেসবুকে শেয়ার করতেও দেখা যায়।

এরপর সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি—সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে কয়েকজনের নাম দিয়ে একটি বিবৃতির ছবিও পোস্ট দেন তিনি। তবে যাদের পক্ষ থেকে এই পোস্ট দেওয়া হয়েছে তাদের অনেকেই এই বিবৃতিকে সমর্থন করছে না।

নুরুল আজিম সিকদার যে আওয়ামী পরিবারের সন্তান সে বিষয়ে দায়িত্ব নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন উত্তর জেলা যুবলীগের বর্তমান সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এস এম রাশেদুল আলম। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন নুরুল আজিম সিকদারকে শিবির বলে পোস্ট দেয় তখন আমিও মনে করেছিলাম তা সত্য। পরবর্তীতে আমি রাঙ্গুনিয়া পৌর মেয়র শাহজাহান সিকদার ও রাঙ্গুনিয়া যুবলীগের সভাপতি আরজু সিকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা আমাকে জানালেন, নুরুল আজিম সিকদার ছাত্রজীবনের শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। পরে আমি আরও কয়েকজন থেকে জেনে নিশ্চিত হলাম, ফেসবুকে ভুল তথ্যই ছড়িয়েছে। এমন পরিবারের কারও অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদারের এলাকা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, নুরুল আজিম সিকদারের চাচা শাহজাহান সিকদার বর্তমানে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ মনোনীত রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার মেয়র। তার চাচা আরজু সিকদার উত্তর জেলা যুবলীগের বর্তমান কমিটির সিনিয়র সহ সভাপতি ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলা যুবলীগের তিন দফায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

তার ভাই আল হেলাল পুতুল সিকদার রাঙ্গুনিয়া উপজেলা যুবলীগের সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া আরেক ভাই সাজিদুল আলম সিকদার উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। নুরুল আজিম শিকদারের আরেক ভাই আল মামুন পিনু সিকদার রাঙ্গুনিয়া পৌরসভা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। তার আরেক ভাই আল যায়েদ সিকদার সম্রাট বর্তমান চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

এদিকে প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদারকে শিবির বানিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহবুব এলাহীর ফেসবুকে দেওয়া বিবৃতিতে নাম থাকা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পাঠাগার সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘কত বড় ধান্ধাবাজির হিসেবনিকেশ থাকলে এক বিবৃতি এক দিনের ব্যবধানে চারবার পরিবর্তন হয় এবং একজনের সিগনেচার নকল করে তাঁকে না জানিয়ে আবার নতুন করে বিবৃতি দেয়া হয় ওয়াক থু….।’

জয়নাল আবেদিন ওই বিবৃতির পোস্টে কমেন্ট করেন, ‘আমার নামটি উইথড্র করে নেন দয়া করে।’ অপর একটি পোস্টে এই বিবৃতিতে ‘ফায়দা লুটার বিবৃতি’ আখ্যা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, চবির পরিস্থিতি নিয়ে আমার আদর্শিক জায়গা থেকে আমি যেকোন অন্যায়, অনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে সবসময়ই প্রতিবাদ করেছি, এখনও করছি এবং ভবিষ্যতেও করবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আমার/আমাদের নাম ব্যবহার করে কোনো ফায়দা লুটার সুযোগ কাউকে দিইনি, দিবোও না কখনও। আশা করি কোনো ধরনের ফায়দা হাসিলের জন্য আমার নাম/মাথা বিক্রি করবেন না দয়া করে। আমি কোন ধরনের ফায়দা লোটার বিবৃতিতে সম্পৃক্ত নই। যারা আমার নাম ব্যবহার করেছেন দয়া করে আমার নাম সরিয়ে নিবেন। ওভার এন্ড আউট।’

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘নুরুল আজিম সিকদার আমার সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন। তার পুরো পরিবার রাঙ্গুনিয়ায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বিভিন্ন পদে থেকে তারা সংগঠনকে এগিয়ে নিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা যারা তাকে নেতিবাচক কথা বলছে তারা তার পরিবারের বিষয়ে হয়তো জানেন না।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উত্তর জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এমএ খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘নুরুল আজিম সিকদার স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যখন ছিলেন তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম না। তাই তিনি কোন আদর্শের লোক তা আমার জানার সুযোগ নেই। তবে আমি জেনেছে, রাঙ্গুনিয়ায় ওনার গোটা পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল টিপু বলেন, ‘প্রক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর বড় ভাইদের কেউ কেউ ওনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলছেন, তার স্বপক্ষে যদি প্রমাণ পাই তাহলে আমরাও তাদের সমর্থন করবো। প্রমাণ ছাড়াতো কারও বিরুদ্ধে বলা যায় না। আমরা শিক্ষার্ধীদের ন্যায্য দাবি আদায় ও ক্যাম্পাসের শান্তি—শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার স্যারের সহযোগীতা চাই।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার বলেন, ‘আমি দায়িত্ব পালনে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগীতা কামনা করছি। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি—শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রক্টরিয়াল বডিকে নিয়ে আমি সচেষ্ট থাকবো। আর যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট, অমূলক।’

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.