আ ন ম সেলিম পটিয়া (চট্টগ্রাম) :
চট্টগ্রামের পটিয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের মেঘা প্রকল্পে কয়েক শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে কেন্দ্র করে বিগত ১৫ বছর সাবেক বিতর্কিত এমপি ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে পটিয়ায় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। সিন্ডিকেটের অন্যান্য সদস্যরা হলেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও ঠিকাদার মনিরুজ্জামান মনির। ৫ আগস্টের পর সামশুল হক চৌধুরী আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর বর্তমানে এই সিন্ডিকেটে ভাগ বসিয়েছে বিএনপির কয়েকজন নেতা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পটিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে প্রায় তের শত কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে।
মাটি ক্রয় ও পরিবহন এবং জমি অধিগ্রহণ ও ফসলি জমির ক্ষতিপূরণ
বাবদ সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হলেও উপজেলার কোন এলাকায় জমির মালিক ও কৃষকদের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে পার্শ্ববর্তী কৃষি জমিকে পুকুরের মত করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। নষ্ট করা হয়েছে কয়েক শত একর কৃষি জমি। একারনে পটিয়ার ২০-২৫ গ্রামের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।
সরেজমিন পরিদর্শন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাইদগাঁও রাজঘাটা ব্রীজের পাশে, ভাটিখাইন বাইপাস সড়কের পাশে ও ভেল্লাপাড়া ব্রীজের পাশে ঠিকাদার মনির ও গোলাম মওলা রতন সহ একাধিক ঠিকাদার ৮-১০ স্পটে ব্লক নির্মাণ কাজ করছেন। এসব স্পটে ইঞ্জিনিয়ারের অনুপস্থিতিতে দেদারসে চলছে নিম্নমানের বালি, সিমেন্ট, পাথর দিয়ে ব্লক ঢালাইয়ের কাজ। এছাড়া একই ভাবে বিভিন্ন ইউনিয়নে মানহীন রড,বালি, সিমেন্ট ও পাথর দিয়ে চলছে সুইচ গেইট নির্মাণ কাজ । এতে কাজের গুণগত মান এবং স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ কাজ করছেন ঠিকাদার মনির।
পটিয়া পৌরসভার সুচক্রদন্ডী গ্রামের ভুক্তভোগী মফিজুর রহমান জানান, সিন্ডিকেটকে শতকরা পাঁচ থেকে দশ ভাগ হারে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে সাধারণ ঠিকাদারদের কাজ করতে হয়। শতকরা দশ ভাগ নিম্ন দরে কার্যাদেশ প্রদান করলেও কোনকোন কাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে সমদরে। এতে সরকারের কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
সাবেক বিতর্কিত এমপি ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও পাউবো’র কতিপয় কর্মকর্তার কমিশন ও টেন্ডার বানিজ্যের কারণে পটিয়ার মানুষের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন পাউবো’র হাজার কোটি টাকার প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
হুমকি-ধমকি ও ক্ষমতার দাপটের কারণে এই সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ কাজ করার সাহস পায়নি। সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ টেন্ডার দিলে তাকে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে হতো। সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে অন্য কাউকে কাজ করতে দেওয়া হতো না।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় লুৎফর রহমান ও নাজমুল হোসেন সহ অনেককে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। উন্নয়ন কাজে পাউবোর কোনো কর্মকর্তার তদারকি নেই বললেই চলে। পাউবো’র প্রকল্প মানেই যেন দুর্নীতি ও অনিয়মের মহোৎসব।
শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ বেশি দরে প্রাক্কলন তৈরী করে টেন্ডারবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্থানীয় প্রতিবাদকারীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। প্রকল্পের সিংহভাগ কাজ ঠিকাদার মনিরুজ্জামান ভাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাজমুল হোসেন নামে নাইখাইন গ্রামের এক ভুক্তভোগী জানান,বেড়িবাঁধের নামে আমাদের প্রায় আড়াই একর কৃষি জমি পুকুরের মত করে মাটি লুট ও ফসলি জমির উপর বাঁধ দেয়া হয়েছে। মাটি ক্রয় ও পরিবহন,জমি অধিগ্রহণ ও ফসলি জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারি বরাদ্দ থাকলেও আমাদের কোন টাকা দেওয়া হয়নি। মাটি ক্রয় না করে পার্শ্ববর্তী কৃষি জমি থেকে নিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করায় শুধু মাটিখাতে শত কোটি টাকা লোপাট করেছে। আমি ক্ষতিপূরণ দাবি করে প্রতিবাদ করায় আমাকে পটিয়া থানার পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে মিথ্যা রাজনৈতিক মামলা দিয়ে জেলহাজতে প্রেরণ করেছে।
জমির মালিকদের প্রথমে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হলেও এ পর্যন্ত তেমন কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি। স্ক্যাভেটর দিয়ে পুকুরের মতো বড় বড় গর্ত করে কৃষি জমি থেকে মাটি নিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে বাঁধ। আবার কোনো কোনো জায়গায় ভরাট হওয়া খালের মাটি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে ফসলি জমি।
হাইদগাঁও গ্রামের সচেতন নাগরিক আজাদ হাসান রিপন জানান,
তদারকি করার কেউ না থাকায় ঠিকাদার নিজের সুবিধামতো নির্মাণ কাজ করছেন। মাঝে মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার গেলেও তাদের সামনে প্রকাশ্যে চলছে নিম্ন মানের কাজ। ঢালাইয়ে কোন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে না। একারণে ব্লকের স্থায়ীত্ব ও মান নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এভাবে কাজ করা হলে তা কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে । ঢালাই কাজের কোন সাইটে পাউবো’র কোন প্রকৌশলীকে দেখা যায়না। শতকরা দশ ভাগ নিম্ন দরে ঠিকাদাররা কাজ করতে আগ্রহী হলেও কিছু কিছু কাজ সিডিউল দরে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এতে সরকারি রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকা।
পটিয়া পওর উপ-বিভাগের
উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আনিস হায়দার খান জানান, ফিল্ড থেকে ব্লক তৈরি করা হলেও আসলে এগুলো ঢাকা থেকে ফাইনাল করা হয়। আমরা কাজের মান বজায় রাখি।
বাপাউবো চট্টগ্রাম পওর বিভাগ-১ এর
নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ জানান,আমরা পাথর,বালি, সিমেন্ট ইত্যাদি নির্মাণ সামগ্রী টেস্ট করেছি এবং প্রকল্প সাইট ও তৈরিকৃত ব্লক সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। আমাদের কাছে সন্তোষজনক মনে হয়েছে। তাছাড়া সিসি ব্লকগুলো উর্ধতন কর্তৃপক্ষ দ্বারা গঠিত টাস্কফোর্সের মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য বুয়েটে পাঠানো হয়। পরীক্ষায় সন্তোষজনক রিপোর্টের ভিত্তিতে ঠিকাদারকে বিল দেওয়া হয়।
প্রকল্প পরিচালক খ.ম জুলফিকার তারেক জানান, আমার জানা মতে এরকম হওয়ার কথা না, ঢালাইয়ে রেডিমেড ব্যবহার করার কথা। কেন ম্যানুয়েল ব্যবহার হচ্ছে তা খতিয়ে দেখব। তাছাড়া তদন্ত করে কোন অনিয়ম দেখলে সাথে সাথে জাজ বন্ধ করে দেব।