আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তির সম্মিলিত কর্মকাণ্ড প্রমাণ করছে—মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র ধারক বাহক এখনও এই দেশে আওয়ামী লীগ
শেখ মুজিব রাজনীতিতে প্রতিদিনই প্রাসঙ্গিক
নতুন করে বলার দরকার নেই—আজ থেকে ৫০ বছর আগে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। বেঁচে ছিলেন শুধু তার দুই কন্যা। তারা জীবিত থাকা অবস্থায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এই রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধুকে দ্বিতীয়বার হত্যা করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা তখন টানা ১৬ বছরের ক্ষমতা হারিয়ে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দিল্লির পথে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কাছে বিজয় সরণিতে ছিল অসাধারণ নান্দনিক বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য। সেটিকে কুৎসিত অবমাননার মাধ্যমে, গলায় রশি দিয়ে মাটিতে ফেলে বিজয় উল্লাস করেছে কিছু লোক।
এই দৃশ্যটি আমার কাছে ২০০৩ সালে বাগদাদের পতনের দিনের মতোই মনে হয়েছিল। আমি তখন ইরাক যুদ্ধ কাভার করতে বাগদাদের প্যালেস্টাইন হোটেলে ছিলাম। দিনের প্রায় একই সময়ে, সাদ্দাম হোসেনের বিদায় ঘণ্টা বাজার পর মার্কিন সেনাবাহিনীর সহায়তায় সাদ্দামবিরোধী জনতা স্বাধীনতা স্কয়ারে তার বিশাল মূর্তির গলায় ক্রেন দিয়ে রশি লাগিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। সাদ্দাম তখন জীবিত এবং অজ্ঞাত স্থানে ছিলেন। মূর্তি ভাঙা ছিল প্রতীকী, ওটাই ছিল সরকারের পতনের চিহ্ন—ইরাকিরা মনে করেছিল তারা স্বাধীনতা পেয়েছে।
কাকতালীয়ভাবে আরেকটি সাদৃশ্য—শেখ হাসিনার আমলে বঙ্গবন্ধুর বন্দনা, প্রতিকৃতি ও নামকরণ যেমন সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল, সাদ্দামের আমলে সারা ইরাকজুড়ে ছিল তার মূর্তি, প্রতিকৃতি আর বন্দনা। টেলিভিশন-পত্রিকায় খবর ছিল এক ব্যক্তিকেই ঘিরে—সাদ্দাম হোসেন।
সে কারণেই বলছি, বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, আর দ্বিতীয় মৃত্যু হয়েছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু যেদিন মারা যান, সেদিন ছিল শুক্রবার। কাকতালীয়ভাবে ৫০ বছর পূর্তির এই দিনটিও শুক্রবার।
ক্ষমতা হারিয়ে আওয়ামী লীগ এখনও অস্তিত্ব জানান দিতে পারছে না। গত বছর এই দিনে তারা ১৫ আগস্ট পালনের জন্য ঢাকায় জনসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল। কর্মসূচিটি ছিল মূলত অভ্যুত্থানের পর পাল্টা অভ্যুত্থানের মতলব বা রাষ্ট্রে ‘গ্যাঞ্জাম’ তৈরির কৌশল। কারণ ১৫ আগস্ট ঢাকায় যারা আছেন, তারাই ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানাতে যথেষ্ট। কর্মসূচি করলে গোপালগঞ্জে যাওয়ার আহ্বান জানানোই ছিল যুক্তিসঙ্গত—যেমন আগে হতো।
কিন্তু আওয়ামী লীগের ব্যর্থ নেতৃত্ব তা করেনি; বরং ঢাকায় গোলযোগ পাকাতে চেয়েছিল বলে ৩২ নম্বর ঘিরে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। কিছু সাধারণ মানুষকে নির্যাতন, কাপড় ছিঁড়ে অপমান করা হয়েছে।
এক বছর পর পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। এবার বঙ্গবন্ধুর দলটিকে সরকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা নিবেদনে বাধা দিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে ঘটেছে আরও ন্যক্কারজনক ঘটনা—৫ আগস্টে আগুন দেওয়ার পর, ছয় মাস পরে ৫ ফেব্রুয়ারি বুলডোজার দিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়িটি ধ্বংস করা হয়, যেখানে ছিল তার স্মৃতি জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার সব কর্মসূচিতে সরকার কোনও বাধা দেয়নি; ধ্বংসের পর লোকদেখানো বিবৃতি দিয়েছে।
এবারও একই কায়দায় ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষকে পুলিশ দিয়ে বাধা দেওয়া হয়েছে, বহুজনকে গণপিটুনি দিয়েছে মব। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়েছে ৩২ নম্বর ঘিরে আতঙ্ক। বিএনপির নাম করে একদল লোক ব্যান্ড পার্টি আয়োজন করেছে, স্লোগান দিয়েছে—“তারেক, তোমায় কথা দিলাম ৩২ দখল নিলাম।” বিএনপি এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেনি—তাদের পরিচিত নেতারাই এতে জড়িত ছিল। এমনকি একজন ইসলামী ছাত্রশিবির নেতাকেও পিটিয়েছে, যে এসেছিল বঙ্গবন্ধুপ্রেমী জনতাকে ধাওয়া দিতে। পরে ছাত্রদল নেতারা ক্ষমা চেয়েছে—ভেবেছিল তিনি ছাত্রলীগের লোক। মানে দাঁড়াচ্ছে, ছাত্রলীগ হলে ‘মারাই বৈধ’, কিন্তু শিবির হলে কেন মারা হলো—এই দ্বিচারিতা।
৫ আগস্টের পর থেকে এনসিপি ও জামায়াতের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলেছে—কে বেশি মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে হেয় করতে পারে, আওয়ামী লীগের প্রতি ঘৃণা দেখাতে পারে। ১৫ আগস্টের পর মনে হচ্ছে বিএনপিও তাতে যোগ দিয়েছে।
বিএনপি ৫ আগস্টের পর ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচনের পক্ষে ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে কথা বলেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ ভেবেছিল, আওয়ামী লীগ তার পরিণতি বরণ করলেও অন্তত স্বাধীনতার আরেক নেতা জিয়াউর রহমানের দল মুক্তিযুদ্ধকে মুছে দিতে দেবে না। কিন্তু তারা সেই আশা পূরণ করেনি—যখন মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান, বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য ও মুক্তিযুদ্ধের মুরাল ধ্বংস হয়েছে, তারা চুপ থেকেছে। বরং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে প্রথম ক্রেডিট নিতে এগিয়ে এসেছে—“আমরাই প্রথমে বলেছিলাম নিষিদ্ধ করতে।”
এত কিছুর পরেও, ১৬ বছরের দুঃশাসনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শাসনের ব্যর্থতার কারণে জনগণ আবার আওয়ামী লীগকে স্মরণ করছে। তাদের অপকর্ম মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। বিএনপির ভুল রাজনীতি, ক্ষমতালোভ, চাঁদাবাজি, মিথ্যা মামলা ও মব ভায়োলেন্সে জড়িয়ে পড়া জাতিকে আশ্বস্ত করছে না যে তারা ক্ষমতায় এলে দেশ শান্তিতে থাকবে। অন্যদিকে জামায়াত গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের স্থান নাই, নিজামীর বাংলায় আওয়ামী লীগের স্থান নাই স্লোগান দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কোন বাংলা চায়। জাতীয় সংগীতে তাদের আপত্তি, এমনকি ঢাকায় মহাসমাবেশ করে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেনি, যদিও সংগীতের জন্য বরাদ্দ রেখেছিল তারা আলাদা কয়েক ঘণ্টা।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে অপমানের প্রতিটি প্রচেষ্টা উল্টে তাকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলছে জাতির কাছে। ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ যত কথা বলছে, বিএনপি ও তার মিত্ররা তার চেয়েও বেশি বলছে বিপক্ষে। দুই পক্ষই বঙ্গবন্ধুকে প্রাসঙ্গিক রেখেছে। বরং শেখ হাসিনার আমলের লোকদেখানো শ্রদ্ধার চেয়েও আন্তরিক শ্রদ্ধা এখন মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগকে অনেকে বলতো ‘মুক্তিযুদ্ধের ফেরিওয়ালা’, ‘চেতনার ব্যবসায়ী’। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তির সম্মিলিত কর্মকাণ্ড প্রমাণ করছে—মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র ধারক বাহক এখনও আওয়ামী লীগ। অন্য কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান, মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করা বা স্বাধীনতার বিপরীত বয়ানের বিরুদ্ধে কথা বলছে না।
রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ আবার ফিরতে পারবে কিনা, তা বড় প্রশ্ন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ৫০ বছর পরও, দ্বিতীয় মৃত্যুর পরও, তিনি যে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য প্রাসঙ্গিক—তার প্রমাণ তিনি প্রতিদিন রেখে যাচ্ছেন।
আমি বারবার একটা কথাই বলি- ব্রাশ দিয়ে অনেক কিছুই মুছে ফেলা যায় কিন্তু হৃদয়ে যারা দাগ কেটে আছে তাদের মোছা সম্ভব হয় না। বঙ্গবন্ধুও তেমনি বাংলাদেশিদের হৃদয়ে দাগ কেটে আছেন, ৩২ নম্বরের ইমারত কিংবা ভাস্কর্য ধ্বংসের মাধ্যমে তাকে ধ্বংস করার চিন্তা করে লাভ নাই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট