সাতকানিয়া সাবরেজিস্টার অফিস:খন্ডকালীন কর্মচারী থেকে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক শাকিল
রয়েছে জায়গার ব্যবসা ও হাসপাতালের মালিকানা -
সৈ.আ.উ/ রুকন উদদীন রুবেল, চট্টগ্রাম
আরো পড়ুন
রাষ্ট্র সংস্কার হচ্ছে, সংস্কার হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সেবাখাত। কিন্তু এখনো সংস্কারের নজর পড়েনি চট্টগ্রামের সাতকানয়া সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে। নিয়মিত চলছে ঘুষ লেনদেন, এমনকি প্রতিটি দলিল রেজিষ্ট্রিতে সরকার রাজস্ব পাক না পাক কিন্তু সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের তহবিলে জমা হতে হবে মৌজা মূল্যের ১% হারে টাকা। আর এই সম্পূর্ণ লেনদেন হয়ে থাকে সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের কর্মচারী শাকিলের হাত দিয়ে।
অভিযোগ রয়েছে, শাকিলের হাতে গ্রহীত টাকা সাব-রেজিষ্টারের মাধ্যমে বিতরণ হয়ে থাকে। এছাড়াও ঘুষ বাণিজ্য চালু রাখতে বিভিন্ন সময় স্থানীয় প্রভাবশালীদেরকেও মাশোহারা দেয় বলে জানা গেছে।
তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে একাধিকবার চেষ্টা করেও শাকিলের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের মাধ্যমে যে কয়েক ধরনের দলিল রেজিষ্ট্রি হয় তার মধ্যে সরকার সর্বোচ্চ রাজস্ব পায় সাফ-কবলা, দানপত্র ও এয়াজনামা যথাক্রমে মৌজা মূল্যের ৭.৫%, ৫.৫% ও ৭.৫% টাকা। আর এই তিনটি দলিল সাতকানিয়া সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে নিয়মিত রেজিষ্ট্রি হয়।
সম্প্রতি হেবা দলিল রেজিষ্ট্রি নেওয়া এক ব্যক্তির মাধ্যমে এই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যক্তি বলেন, আমি কয়েকদিন আগে একটি হেবা দলিল রেজিষ্ট্রি করি যার মৌজা মূল্য আনুমানিক ৫৫ লাখ টাকা। আমার কাছে দলিল লেখক মৌজা মূল্যের ২% টাকা দাবি করেন।
কিন্তু বলে বুঝিয়ে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে আমি দলিলটি রেজিষ্ট্রির কাজ সম্পন্ন করি। তবে এই টাকা কোথায় কত টাকা ব্যয় হয়েছে এই বিষয়টি জানতে অনুসন্ধানে নামলে খোঁজ মিলে ওই দলিল লেখকের।
তিনিও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের মৌজা মূল্যের ১% টাকা অফিসকে দিতে হয়। আমি এই দলিলে অফিসকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি। কার হাতে দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সব লেনদেন শাকিল ভাইয়ের হাত দিয়ে করি। ওই দলিল লেখক আরো বলেন, আমরা শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে ওয়াকফ দলিল ছাড়া সব দলিলে মৌজা মূল্যের উপর ১% হারে অফিসকে ক্যাশ টাকা প্রদান করি। এটি অনেক আগে থেকেই নিয়ম হয়ে আছে। তবে দলিল বড় হলে বিশেষ করে কোটি টাকা মৌজা মূল্য হলে অফিসকে একটু কম টাকা দিয়ে থাকি এবং কাষ্টমার থেকে আমরাও কম নিয়ে থাকি। কিন্তু ছোট দলিলে অফিসে কম টাকা দেওয়ার সুযোগ থাকেনা।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, এই ১% শতাংশ টাকা ব্যক্তি বিশেষে অনেকেই ছাড় পেয়ে থাকেন। বিশেষ করে স্থানীয় কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আইনজীবীদের ক্ষেত্রে এই টাকার সামান্য অংশ দিয়ে রেজিষ্ট্রি সম্পন্ন হয়ে থাকে। এছাড়াও দলিল লিখক সমিতির নেতাদের ক্ষেত্রেও কিছু ছাড় রয়েছে। তবে এই ছাড় .৩% এর বেশী নয়।
এদিকে এই ১% টাকা বছরে কত টাকা হয় জানতে অনুসন্ধানে নামলে সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস হতে কোন প্রকার তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সরকারি খাতে প্রদেয় রাজস্ব হিসেবে দেখা যায়, গত জুন, জুলাই ও আগষ্ট মাসে উৎস কর ব্যতিত সরকার রেজিষ্ট্রি অফিস থেকে সর্বমোট রাজস্ব পেয়েছে ৭ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা। সাধারণত উপজেলা ও পৌরসভার উৎস কর মৌজা মূল্যের ২% ও ৪% শতাংশ হারে জমা হয়ে থাকে।
তবে এই টাকা কোথায় যায় জানতে চাইলে, সাতকানিয়া সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই ১% প্রথা দীর্ঘদিন ধরে চলমান।
লাখ লাখ ঘুষের টাকা প্রতি মাসে লেনদেন হয়। এই টাকা শাকিলের হাত দিয়ে লেনদেন হলেও শাকিল আহামরি পায়না। আমরা যতটুকু জানি, সব টাকা সাব রেজিষ্ট্রারের হাত দিয়ে বন্টন হয়ে থাকে।
তবে এই ১% ঘুষের সিস্টেমটা বন্ধ হওয়া উচিৎ। কারন এই টাকা সম্পূর্ণ সাতকানিয়ার মানুষের পকেট কেটে নেওয়া হচ্ছে। একটি দলিলে ৫০ হাজার ক্ষেত্র বিশেষে লাখ টাকা বেড়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে কষ্ঠের।
তবে দলিল লেখকরা কেন এই বিষয়ে প্রতিবাদ করেনা জানতে চাইলে এই ব্যক্তি আরো বলেন, দলিল লেখকদের যে সরকারী সনদ আছে সেটি নবায়ন করতে সাব রেজিষ্ট্রারের সুপারিশ লাগে। এছাড়াও এই ঘুষের টাকা লেনদেন না হলে দলিল রেজিষ্ট্রিতে সাব রেজিষ্ট্রার কড়াকড়ি আরোপ করবে।
ফলে মানুষের ভোগান্তি বাড়ার পাশাপাশি রেজিষ্ট্রি কমে যাবে এবং রেজিষ্ট্রি অফিস সংশ্লিষ্ট সবার আয় কমে যাবে। এজন্য এ বিষয়ে কেউ কথা বলেনা।
এদিকে ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে সাতকানিয়া সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের সাব-রেজিষ্টার টিনু চাকমা’র মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
এমনকি প্রশ্ন লিখে ডাক যোগে পাঠানো চিঠি রেজিষ্ট্রি অফিসের সীল মোহর দিয়ে গত ২৪ জুলাই গ্রহণ করা হলেও প্রতিবেদন লেখার আগ পর্যন্ত চিঠির কোন প্রকার উত্তর পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার খন্দকার জামীলুর রহমান বলেন, ঘুষ লেনদেনের কথাটা আমরা প্রায় শুনে থাকি। তবে এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ভুক্তভোগীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাইনি।
যেহেতু এখানে দলিল লেখকদের একটা সংশ্লিষ্টতা আছে, সুতরাং নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে প্রকৃত অপরাধীকে তদন্তের মাধ্যমে সনাক্ত করা যাবে। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর রিপোর্ট করতে পারবো।
তিনি আরও বলেন, রেজিস্ট্রি অফিসে সেবা নিতে আসা মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য আমাদের নিয়মিত মনিটরিং চলছে। ভুক্তভোগীরা যদি সরাসরি জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে অভিযোগ করেন অথবা লিখিতভাবে জানিয়ে দেন, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।
এ ক্ষেত্রে কারও প্রভাবশালী পরিচয় বা পদমর্যাদা দেখেও ছাড় দেওয়া হবে না। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর।
তিনি সতর্ক করে বলেন, অভিযোগ না করে কেবল কথাবার্তায় বিষয়টি সীমাবদ্ধ রাখলে সমস্যার সমাধান হবে না। তাই জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন।
সাতকানিয়ার একাধিক বাসিন্দার তথ্যমতে এই শাকিলের রয়েছে সাতকানিয়া পৌরসভা এবং কেরানিহাটের একাধিক প্রাইভেট হাসপাতালের মালিকানা এবং নামে বেনামে দোকান ও জায়গা।
খতিয়ানে দোকান উল্লেখ থাকলে নিয়মমতো রেজিষ্ট্রেশন ফি বেশী দিতে হয় নাল জমি থেকে, এক্ষেত্রে সুকৌশলে বিরাট অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় এই শাকিল।
সাতকানিয়া সাবরেজিস্টার অফিসে অফিসার থাকলেও রেজিস্ট্রেশন হয়না যদি কোন কারণে শাকিল অফিসে আসতে না পারেন।
মূলত অঘোষিত ভাবে এই শাকিলই মূল হর্তাকর্তা সাতকানিয়া সাবরেজিস্টার অফিসে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক দলিল লেখক বলেন -শাকিল নিয়োগকৃত কোন কর্মচারী নয়, তাকে অস্থায়ী ভাবে রাখা হয়েছে শুধু ঘুসের খাতটি দেখার জন্য এবং এতেই তার মাসিক ইনকাম ২কোটির কাছাকাছি।
ধারাবাহিক পর্ব-০২