বর্ষার আগমনে স্বস্তি ফিরে ছাতা কারিগরের মনে,তবে তাদের দুঃখের গল্প জানে ক’জনে?

আনোয়ারা প্রতিনিধি: নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে॥ ঘরের টিনে ঝুমুর ঝুমুর বৃষ্টি’র শব্দ আর হাঁটু কাঁদা রাস্তা যখন দেখা মিলে গায়ের আঁকা বাঁকা পথে। তখন-ই বুঝতে হবে কবি-কাব্যের ঋতু বর্ষা এসে হানা দিয়েছে গায়ে। এখন আর একটু অবহেলায় স্কুলে বা কাজে বের হওয়ার সময় ছাতা ছাড়া বের হওয়ায় বিপদ। কারণ বর্ষাকালে রোদ আর বৃষ্টির খেলার মাঝে কখন যে কাক ভেজা হয়ে ফিরতে হয় ঘরে তার কোন ঠিকঠিকানা নেই বললেই চলে। রোদেলা তাপ বা বৃষ্টির ধারা থেকে মুক্তির জন্য ছোট্ট এই বস্তুর প্রয়োজনটা যে কত তা এই মৌসুমেই বলে দেয়। একুশ শতকের আগে কাঠের হাতলের ছাতা থাকলেও এরপর থেকে ছাতার হাতল ও কাপড়ে বৈচিত্র এসেছে। বিভিন্ন রঙের নজরকাড়া ডিজাইনের হরকরকম সাইজের ছাতা ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছোট্ট সাইজের ছাতা স্কুল ব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ কিংবা প্যান্টের পকেটেও রাখা যায়। যত বৈচিত্রময় হোক ছাতা উল্টে গেলে, কাপড় ছিঁড়লে বা সেলাই খুলে গেলে ছাতা কারিগর ছাড়া কিন্তু কোনো উপায় নেই। তাই বর্ষা মৌসুমে যেহেতু ছাতার ব্যবহার বেড়ে যায়, তাই অন্যন্য মৌসুমে দিনমজুরী করে খাওয়া ছাতা কারিগরদের মনে স্বস্তিও আসে। আর এজন্যই বর্ষার এই সময়টাতে কদর বাড়ে ছাতার কারিগরদের। বিভিন্ন হাট-বাজারে ফুটপাতে, টং দোকানে ছাতা মেরামতের নানান সামগ্রী নিয়ে কাজে ব্যস্ত থাকেন তারা। কারও ছাতার শিকের সুতো ছিঁড়ে গেছে, কারও শিক ভেঙ্গে গেছে, কারওবা পুরোটাই মুমূর্ষু। সবকিছুই ঠিকঠাক করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন এই কারিগররা। কার ছাতা কে আগে মেরামত করে নেবে তার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কারণ বর্ষকালে সবচেয়ে উপকারী বস্তুটির নামই হলো ছাতা। সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম আনোয়ারা উপজেলার প্রায় প্রতিটি ছোট বড় হাট বাজারের ফুটপাথে ছাতা তৈরির কারিগর রয়েছে। এরা অন্যের দোকানের সামনে নামমাত্র ভাড়ায় বসে ছোট্ট একটা চকি বা বক্স নিয়ে কাজ করেন এবং কাজ শেষে ঘরে ফিরে যান। এছাড়াও ভ্রাম্যমাণ ছাতা কারিগররা গ্রামের অলিতে-গলিতে ঘুরে ঘুরে ছাতা মেরামত করার যন্ত্রপাতি কাঁধে নিয়ে “এই ছাতা ঠিক করাই” আওয়াজ তুলে ঘরে ঘরে গিয়ে ছাতা মেরামত করে থাকেন। এই ছাতা বর্ষাতে যেমন দরকার তেমনি গ্রীষ্মেও এর প্রয়োজন দেখা দেয়। তবে মূলত বর্ষাকালেই ঘরে তুলে রাখা ছাতা মেরামত করতে নিয়ে আসেন ব্যবহারকারীরা। অন্যান্য বছর বর্ষার মৌসুমে প্রতিদিন ৭০০-১০০০ টাকা ইনকম হলেও এইবছর লগডাউনের ফলে এই মৌসুমী কারিগরদের ইনকাম ৩০০-৪০০ মধ্যে চলে এসেছে। যা দিয়ে নিজেদের খরচ ফুঁসিয়া পরিবার চালানো কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে জানান উপজেলার ছাতা কারিগররা। জয়কালী হাটের ছাতা মেরামত করতে আসা শান্তা নামের এক ছাত্রী বলেন, সকালে টিপ ছাতা নিয়ে টিউশনে গেছিলাম । আসার সময় বৃষ্টি আর বাতাসে হঠাৎ ছাতার কয়েকটা শিক ভেঙে গেছে তাই মেরামত করতে আসছি। উপজেলার ১০ নং হাইলধর ইউনিয়নের মালঘর বাজারে ৮২ বছর বয়সী কমলা কান্ত নাথ নামের এক ছাতা কারিগর বলেন, প্রায় ৬৫ বছর যাবৎ এই পেশার সঙ্গে আছি । এ পেশায় আর আগের মতো লাভ নেই। মানুষ এখন আর ছাতার কাজ করে না। হাটের দিন বিভিন্ন বাজারে কাজ করি। এ ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত মালঘর বাজারে থাকি । বয়স হয়ে গেছে, শরীরে আগের মতো আর জোর নাই। চোখেও দেখিনা । দিনে ৫-৬ ঘন্টা নিজের এই ব্যবসায় সময় দিই। বাপদাদার আমল থেকে এই কাজ করে আসছি । এখন ছেলেরা মানুষ হয়েছে । যদিও আমি এই পেশা সাথে ছোট থেকে জড়িত তাই এই পেশার সাথে একটু মহব্বত হয়ে গেছে এই কারণেই ছুটি আসা। উপজেলার রন্জিত নাথ (৬৯) নামের অন্য এক ছাতা কারিগর তার কষ্ট ও দুর্বিসহ জীবনের কথা তুলে ধরে বলেন, ১৫ বছর ধরে ছাতা মেরামতের কাজ করে আসছি। দৈনিক ডজন খানেক ছাতা মেরামত করে ৪শ থেকে ৫শ টাকা আয় করি। বছরে ছাতা মেরামতের কাজ হয় শুধু বর্ষাকালীন এই ৩-৪ মাস। বাকি সময় দিনমজুরি করে যে কাজ পাই সে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। খুব কষ্টে পরিবার নিয়ে জীবন পার করছি। কখন ও কাষ্টমার পাই কখন ও পাইনা। আগের মতো আর কামাইধান্দা নাই। আধুনিক যুগে মানুষ এখন আধুনিক জিনিস ব্যবহার করছে। তার ওপর করোনা আর লকডাউনে সব শেষ করে দিয়েছে। ২ বছরে কোন সরকারি সহায়তা ও পাই নাই । যখন কাজ থাকেনা তখন বর্গা চাষ করি । শুনেছি সরকার মানুষকে চাষের জন্য বীজ আর সার দেই এই পুরা কপালে তাও জুটেনি কোনোদিন। এখন এইসব বলতেও ভয় লাগে কখন আবার মামলা হামলা করে বসে। ভ্রাম্যমাণ ছাতার কারিগর নোয়াখালী থেকে আসা মোঃ ইয়াছিন শেখ জানান,জীবিকার তাগিদে নিজের জেলা থেকে চট্টগ্রামে আসা। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি এ পেশায় জড়িত। অন্যান্য বছর দৈনিক ৭শ-হাজার টাকা ইনকাম হলেও এইবার লগডাউনের কারণে তেমন ছুটাছুটি করতে না পারায় আগের মতো রুজি রোজগার হচ্ছে না। যা পাই কিছু নিজে রাখি বাকিটা বউ-বাচ্চার লাই পাঠাই।

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.