সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে লোহাগাড়ার গুপ্ত জমিদারবাড়ি

তিনশো বছরের ইতিহাসের সাক্ষী দক্ষিণ চট্টগ্রামের গুপ্ত জমিদার বাড়ি। ১৭শ সালের দিকে কাঠ, চুন, সুরকি ও ইট দিয়ে তৈরী বাড়িটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জমিদার বাড়িজুড়ে নান্দনিক, দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর কারুকাজ ঐতিহ্যের নিদর্শন ও প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী। জেলার লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের তেওয়ারিহাট সংলগ্ন এলাকায় গুপ্ত জমিদার বাড়ির অবস্থান। গুপ্তধনের বদৌলতে হঠাৎ জমিদার বনে যাওয়া রামমোহন তার ধর্মবোন বিলকিসকে সঙ্গে নিয়ে ১০ একর জমির উপর বাড়িটি নির্মাণ করেন। কথিত আছে, বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ কখনো জুতা পায়ে, ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটতেন না। স্বয়ং বিটিশরাও এ জমিদার বাড়িকে সম্মান জানাতো।

ইতিহাস ও স্থানীয়দের তথ্যমতে, জমিদার বাড়িটি প্রায় তিনশত বছর আগে জমিদার রামমোহন গুপ্ত তৈরি করেন। মূলত এই জমিদারের পূর্বপুরুষরা ময়মনসিংহ জেলা থেকে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় এসে বসতি স্থাপন করেন। তখন এই এলাকাটি আরকান রাজ্যের অধীনে ছিল এবং এখানে একচেটিয়া আদিবাসী অর্থাৎ মগ, চাকমা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। তখন তারা বাঙালিদের উপর অত্যাচার করত। তাই মগ, চাকমা ও অন্যান্য আদিবাসিদের এই এলাকা ছাড়ার জন্য রামমোহন গুপ্ত হিন্দু ও মুসলমান বাঙালি জাতিকে নিয়ে আদিবাসী খেদাও আন্দোলন গড়ে তোলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা এই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় রামমোহন গুপ্ত হিন্দু ও মুসলমান বাঙালি জাতির কাছে একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন এবং সকলের বিপদ আপদে সাড়া দিতেন। তার সাথে একসময় এক মুসলিম মহিলার সাথে পরিচয় হয়। যার সাথে তিনি ধর্মবোনের সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

হঠাৎ একদিন ঐ মহিলা স্বপ্নের মাধ্যমে গুপ্তধনের সন্ধান পান। তখন তিনি তার ধর্মভাই রামমোহনকে নিয়ে উক্ত গুপ্তধন উদ্ধার করেন। তবে তার তেমন কোনো আপন কেউ না থাকাতে ধর্মভাই রামমোহনকে সকল সম্পদ দান করেন। আর এই বিশাল সম্পদ দিয়ে রামমোহন গুপ্ত তার এই জমিদারীর সূচনা করেন। এরপর তিনি ও তার বংশধররা জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত জমিদারী পরিচালনা করতে থাকেন। রামমোহন গুপ্ত ছিলেন অত্যান্ত প্রজাহিতৈষী জমিদার। তিনি তার প্রজাদের জন্য অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন।

অনেক মসজিদ, মন্দির ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। জমিদার রামমোহন গুপ্ত তার ধর্মবোন মারা গেলে তার জন্য প্রতি বছর তিনি একই রঙের প্রায় আটটি গরু জবাই করে মেহমানদারির আয়োজন করতেন। জমিদার রামমোহন গুপ্ত মারা যাওয়ার পর পরবর্তী জমিদাররা আস্তে আস্তে রামমোহনের ধর্ম বোনের জন্য করা মেহমানদারি বন্ধ করে দেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এক সময়ের প্রতাপশালী জমিদার রামমোহনের উত্তরসূরিদের এখন দিন কাটছে অভাব-অনটনে। পুরো ভবনটিরই এখন জরাজীর্ণ অবস্থা। যে কোনো সময় ভেঙে পড়ে ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এরপরও ঝুঁকি নিয়ে এ ভবনে বসবাস করছেন কিছু বংশধর। বাকিরা চট্টগ্রাম শহরে। অন্য একটি অংশ ভারতে চলে গেছে। স্থানীয়রা বলছে, গুপ্ত জমিদার বাড়িটি সরকারি ভাবে সংস্কারের উদ্যোগ না নিলে দিনে দিনে বিলীন হয়ে যাবে। ইতিহাস থেকে নাম মুছে যাবে ঐতিহ্যবাহী এই জমিদারবাড়ির।নতুন প্রজন্ম দেখতে পারবেনা শেষ স্মৃতিটুকুও।

লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবিব জিতু বলেন, প্রাচীন এ জমিদার বাড়ী বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। এটি সংরক্ষণ ও এর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর বরাবর পত্র প্রেরণ করা হবে। তাছাড়া উপজেলা প্রশাসন এর পক্ষ থেকেও এটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে।

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.