চবি উপাচার্যের আদরের কর্মচারী নেতা শহীদ বেপরোয়া মারমুখী

সোহরাব সাহল 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত নুরুল ইসলাম শহীদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ভবনে কর্মরত। তার আরেক পরিচয় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক।

উপাচার্য তাকে বেশ ‘দেখতে’ পারেন বলেই বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে তিনি দেখান ক্ষমতার জোর। আচরণ করেন বেপরোয়া। মাঝেমধ্যে হয়ে উঠেন মারমুখী। কথায় কথায় উপাচার্যের নামে বাহাদুরি করে অন্যায় আবদার চলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দফতরে। এমন অভিযোগ হরহামেশাই উঠে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা নেয় না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য কিংবা প্রশাসন শহীদকে বেপরোয়া হয়ে উঠতে উৎসাহীত করছে কি-না সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি ‘ব্যক্তিগত তদবির’ না রাখায় হিসাব নিয়ামক দফতরের দরজায় লাথি দিয়ে ফের আলোচনায় আসেন। আবার কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রাণনাশের হুমকিও দিয়েছেন। সর্বশেষ হিসাব নিয়ামক দফতরে তালা লাগিয়ে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগও উপাচার্যের ‘আদরে’ বেপরোয়া কর্মচারী নুরুল ইসলাম শহীদের বিরুদ্ধে।

গত ৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবরে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও দেন হিসাব নিয়ামক দফতরের বেতন ও ভাতা শাখার নয় কর্মকর্তা।

অভিযোগসূত্রে জানা যায়, কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম শহীদ তার পছন্দের ৩ কর্মচারীকে নিয়মবহির্ভূতভাবে চিকিৎসা লোন প্রদান করতে হিসাব নিয়ামক দফতরে চাপ দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু হিসাব নিয়ামক শাখা তাকে সিরিয়ালি লোন প্রদান করা হবে বলে জানান। একই তদবির নিয়ে সে তারই সমিতির সভাপতিকেও চাপ দেন। কিন্তু তিনিও সাফ জানিয়ে দেন, এ ধরণের অন্যায় তদবির তিনি করতে পারবেন না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ঘটনার দিন মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় হিসাব নিয়ামক দফতরে গিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই দরজায় একটার পর একটা লাথি মারতে থাকে। এরপর সে উপস্থিত সবাইকে গালিগালাজ করে প্রাণনাশের হুমকি দেয় এবং একপর্যায়ে দরজায় তালা লাগিয়ে চলে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, ২০১৮ সালে কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠে শহীদ। শুরু থেকে সমিতির জন্য কাজ না করে ব্যক্তিগত কাজ ও তদবির নিয়ে ব্যস্ত ছিল সে। প্রভাব খাটিয়ে নিজের অস্থায়ী চাকরি স্থায়ী করার পাশাপাশি আদায় করে নেন পদোন্নতি। নিজের পছন্দমতো দফতরে বদলিও হয়ে যান খুব দ্রুত। এসব কিছুর মধ্যে নিজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরাদ্দ নেন একটি কোয়ার্টারও।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কর্মচারী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ২০১৯ সালে তৎকালীন রেজিস্ট্রার নুর মোহাম্মদসহ রেজিস্ট্রার দফতরের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অশালীন আচরণ করে। এ ঘটনায় রেজিস্ট্রার নুর মোহাম্মদ অভিযোগ দায়ের করতে গেলে কর্মচারী সমিতির বর্তমান সভাপতি আনোয়ার হোসেনের উপস্থিতিতে রেজিস্ট্রারের পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে পার পান শহীদ। এছাড়া তৎকালীন আরেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার ও তৃতীয় শ্রেণির সেল প্রধান মো. শাহ আলমের অফিসেও ব্যক্তিগত তদবির নিয়ে অশালীন আচরণ করেন বলে জানা যায়। এরকম আরও অনেক উগ্র আচরণে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে বেশ সমালোচিত সে।

এ বিষয়ে কর্মচারী সমিতির সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ব্যক্তিগত তদবির নিয়ে সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসাব নিয়ামক দফতরে তালা লাগানোর বিষয়টি আমি শুনেছি। এ ঘটনায় উপাচার্য বরাবর দাখিল করা অভিযোগের অনুলিপি আমি পেয়েছি। কয়েকদিনের মধ্যে জরুরি কার্যনির্বাহী কমিটির সভা ডাকা হবে। সেখানে বিষয়টি উত্থাপন করে কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার বিরুদ্ধে এরআগেও বেশ কিছু মৌখিক অভিযোগ রয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চবি কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম শহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ দিছে, দরজায় তালা লাগানো ছাড়া বাকিসব মিথ্যা। আমি দুইমাস আগে তাদের বিরুদ্ধে প্রধান হিসাব নিয়ামকের কাছে অভিযোগ দিয়েছিলাম। তিনি অভিযোগটি ইফতেখারকে দিলে দুইমাসে কোন সুরাহা হয়নি। আমার দেওয়া অভিযোগ ঢাকতে তারা এখন আবার আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছে। অভিযোগকারী নয়জনের মধ্যে চারজন জানেও না কি অভিযোগ দিচ্ছে। ঘটনার দিন আমি বেতন ও ভাতা শাখায় গিয়ে আমার অভিযোগ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কারও অফিস করার দরকার নেই বলে তালা লাগিয়ে দিই। পরে রেজিস্ট্রার স্যার এসে আমার বিষয় সমাধানের আশ্বাস দেওয়ায় আমি তালা খুলে দিই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি যাদের চিকিৎসা লোন নিতে সুপারিশ করেছি তারা সবাই মরণাপন্নরোগী। অথচ এখন যারা লোন নিচ্ছে তারা অনেকেই চিকিৎসা লোন নিয়ে মোটরসাইকেল কিনেছে। তাদের মধ্যে একজন সুমন মামুনও রয়েছেন। আমি তিন বছরে মাত্র ১০ জনের জন্য তদবির নিয়ে গেছি অথচ আমার সভাপতি মাসে পাঁচজনের তদবির নিয়ে যায়।’

জানতে চাইলে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, ‘আমি ঘটনার দিন অন্য একটা অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।’ বলেই ফোনটা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূইয়ার কানে দেন।

এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর বলেন, ‘এটা কর্মচারীদের নিজেদের সমস্যা। তারা ঠুনকো বিষয় নিয়ে বিবাদে জড়িয়েছে। আমি শুনার সঙ্গে সঙ্গে শহীদকে ফোন দিই এবং সে ঘটনাস্থল থেকে চলে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।’

সূত্রঃ দৈনিক পূর্বদেশ।

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.