সৈয়দ আককাস উদদীন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকে-
জাতীয় পরিচয় পত্র বা ভোটার হওয়া দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। নির্দিষ্ট বয়সে নাগরিকরা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট প্রদান এবং সরকারি বেসরকারি সকল সুবিধা ভোগ করার জন্যই মূলত জাতীয় পরিচয় পত্রের দরকার হয়। এছাড়াও জাতীয় পরিচয় পত্র দেশের একজন নাগরিকের প্রধান স্বীকৃতি।
তবে এই জাতীয় পরিচয় পত্র পেতে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আগমনের পর থেকেই মূলত এই সমস্যার সৃষ্টি। এর আগে কেবল পিতা মাতার জাতীয় পরিচয় পত্র আর মুষ্টিমেয় কয়েকটি কাগজ পত্র দিলেই ভোটার হওয়া যেত। তবে বর্তমানে ভোটার হতে দরকার পড়ছে ১৮ ধরনের কাগজ পত্র। এর পরেও বিভিন্ন সময় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অনেক মানুষ।
সম্প্রতি সাতকানিয়া সহ আরো কয়েকটি উপজেলায় শুরু হয়েছে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম। নির্বাচন অফিস থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীরা ঘরে ঘরে গিয়ে সংগ্রহ করছে ভোটারদের তথ্য। এতে করে নতুন আরেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে নাগরিকদের। গত ৩ আগষ্ট নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, জমির খতিয়ান উপজেলা ভূমি অফিসে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও তহশিলদার কর্তৃক সীল সহ সত্যায়িত করে ভোটার ফরমের সাথে জমা দিতে হবে। আর এতে করেই শুরু হয়েছে নতুন ভোগান্তি। কেবল একটি স্বাক্ষরের জন্যই অনেকেই সংশ্লিষ্ট অফিসের সামনে দাড়িয়ে থাকছেন ঘন্টার পর ঘন্টা।
চট্টগ্রাম জজ আদালতের আইনজীবী এডভোকেট রাশেদুল ইসলাম বলেন, ভোটার ফরমের সাথে খতিয়ান নেওয়া এবং সত্যায়িত করা এটি সম্পূর্ণ জনসাধারণকে হয়রানির কাজ। আমার বাবা মায়ের জাতীয় পরিচয় পত্র আছে। তাও দীর্ঘদিন আগে তথা রোহিঙ্গা আসার আগে রেকর্ড হয়েছে। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আর কি হতে পারে। তবে হ্যা, যদি বাবা মা সহ সম্পূর্ণ নতুন ভোটার হয় এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের খতিয়ান কিংবা অন্যান্য তথ্য চাওয়া যৌক্তিক। কারন যেহেতু বর্তমানে রোহিঙ্গাদের অনেকেই আমাদের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে বর্তমানে যা হচ্ছে এটি কেবল জনগণকে হয়রানি করা ছাড়া কিছুই নয়। কোন আইনে নির্বাচন কমিশন এই আদেশ জারি করল এবং কেন করল নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা দেওয়া উচিৎ।
সরেজমিনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় দেখা যায়, সাধারণ লোকজন খতিয়ানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষর নিতে লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে। প্রথমে তহশিলদার অফিসে এবং পরবর্তী ভূমি অফিসে লম্বা লাইনে দাড়িয়ে স্বাক্ষর নিচ্ছে।
জানতে চাইলে আব্দুল আলিম নামে ভুক্তভোগী এক ব্যক্তি বলেন, ছেলেকে ভোটার করানোর জন্য আজকে এক সপ্তাহ ধরে শুধু এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছি। কতক্ষণ পৌরসভায় কতক্ষণ ভূমি অফিসে। এখনো কাজ শেষ হয়নি। মনে হচ্ছে আমরাই রোহিঙ্গা হয়ে গেলাম।
অপর একজন বলেন, এমন কোন কাগজ নাই যেটা দিতে হচ্ছেনা। নতুন করে খতিয়ান সত্যায়িত করতে গিয়ে অতিরিক্ত ভোগান্তির শিকার হলাম। স্বাধীন দেশর নাগরিক হিসেবে ভোটার হতে এত কাগজ পত্র দেওয়াটাও এক প্রকার লজ্জা জনক। নিজেকে এদেশের নাগরিক নয়, মনে হচ্ছে যেন শরনার্থী। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েও অনেকেই ভোগান্তির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
আদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবু তালেব মন্ডল বলেন, আমরা কেবল কমিশনের আদেশ বাস্তবায়ন করছি। আমাদের আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার নেই।
জানতে চাইলে সাতকানিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মং চিংনু মারমা বলেন, আমরা নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের আদেশ বাস্তবায়ন করছি। রোহিঙ্গারা যেন ভোটার হতে না পারে সে বিষয়ে কড়া নির্দেশ আছে। বিশেষ করে বিশেষায়িত এলাকার জন্য খতিয়ান সত্যায়িত করার বিষয়টি নির্বাচনের কমিশনের আদেশ। সাতকানিয়া বিশেষায়িত এলাকা হওয়ার কারনে খতিয়ান সত্যায়িত করাটা বাধ্যতামূলক হয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে জারি হওয়া আদেশে কেউ যদি ভোগান্তির শিকার হয় তাহলে বিশেষ কমিটিকে অবহিত করবে। বিশেষ কমিটি চাইলে যেকোন বিষয় শিথিল করতে পারে। আর এই আদেশটি হচ্ছে বিশেষায়িত এলাকার জন্য। যেন ভিন দেশের নাগরিকরা আমাদের দেশের নাগরিকত্ব পেয়ে না যায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য মূলত এসব কাগজ পত্র নেওয়া।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কোন কর্মকর্তা নিজের জন্য এই কাগজ পত্র নিচ্ছেনা। এসবে আমাদের নিজেদের কোন স্বার্থ নেই। তাছাড়া আমার কোন বক্তব্য নেই। আপনি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এবং জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন এই কর্মকর্তা।
সাতকানিয়া উপজেলা বিশেষ কমিটির আহ্বায়ক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে কমিশন খতিয়ানের বিষয়ে একটি আদেশ জারি করেছে। আমাদের কাছে ভোগান্তির বিষয়ে এখনো কোন অভিযোগ আসেনি। যেকোন অভিযোগ পেলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।