যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে যাবে ৪ হাজার টন আম

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আম রফতানির বিপুল সম্ভবনা রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই ইউরোপসহ বেশ কয়েকটি দেশে আম রফতানি হচ্ছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ২৮টি দেশে প্রায় ১ হাজার ৮০০ টন আম রফতানি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এ বছর প্রায় ৪ হাজার টন আম রফতানি হতে পারে। তবে আম রফতানির পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা ফার্মার সার্টিফিকেট ও ফাইটো স্যানিটারি সার্টিফিকেট প্রাপ্তি।

এছাড়া কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের অব্যবস্থাপনা, উড়োজাহাজের ভাড়াও ভাবিয়ে তুলছে উদ্যোক্তাদের। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব হলে খাতটি আরও বেশি সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারে। সংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর আমরা প্রায় ১৮০০ টন আম রফতানি করেছি। এ বছর আম রফতানি আরও বাড়বে। আগামী ২৫ মে শ্যামপুরে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে কেন্দ্রীয়ভাবে আম রফতানি কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন কৃষিমন্ত্রী। সেদিনই আশা করছি ১০ থেকে ১২ টন আম রফতানি হবে। এছাড়া লোকাল পর্যায়েও আম রফতানি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন হচ্ছে। ক্লাস্টার করে আম চাষ করা হচ্ছে। দেশ থেকে আম রফতানি খুবই সম্ভাবনাময়।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘দেশে বাণিজ্যকভাবে উৎপাদিত আমের ৫০ শতাংশ আমরা রফতানি করতে চাই। ভবিষ্যতে যদি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আম রফতানি করা যায় তাহলে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। তবে দেশে কিন্তু আমের ঘাটতি পড়বে না। কারণ প্রতিটি পরিবারেই, গ্রাম গঞ্জে সবার বাড়িতে ৫ থেকে ১০টি আম গাছ রয়েছে। তা দিয়েই অনেক সময় পরিবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়। অর্থাৎ আমরা আম রফতানিতে বিশেষ মনযোগ দিচ্ছি।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, গত বছর ২৮টি দেশে আম রফতানি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি রফতানি হয়েছে যুক্তরাজ্যে, দেশটিতে ৬২৫ টন আম রফতানি হয়। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরবে ২২৬ টন আম রফতানি হয়, আর তৃতীয় অবস্থানে ইতালিতে রফতানি হয়েছিল ১৭৩ টন। এছাড়া আরও যেসব দেশে আম রফতানি হয়েছে সেগুলো হলো- অস্ট্রিয়া, বাহরিন, বেলজিয়াম, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রীস, হংকং, আয়ারল্যান্ড, জর্ডন, লেবানন, মালদ্বীপ, নেদারল্যান্ড, ওমান, পুর্তগাল, কাতার, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, সোয়াজিল্যান্ড, সু্ইডেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ বছর এসব দেশসহ আরও নতুন দেশেও আম রফতানি হতে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশ থেকে ৩০৯ টন আম রফতানি হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি হয় ২৩১ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩০৮ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৭৯ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৯১ টন ও সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৭৫৭ টন আম রফতানি হয়েছে। সর্বশেষ বছরটিতে ১ হাজার ৮২০ টন আম রফতানি হয়েছে। গেল বছরের চেয়ে দ্বিগুণ আম রফতানির লক্ষ্য রয়েছে চলতি বছরে।

এদিকে, দেশে রফতানিযোগ্য আমের উৎপাদন বাড়াতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। রফতানিযোগ্য আমের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অধীন ‘রফতা‌নি‌যোগ্য আম উৎপাদন’ নামে একটি প্রকল্প চলছে। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আম রফতানিকারকরা নতুন নতুন দেশ খুঁজছে, ভবিষ্যতে আরও নতুন দেশেও আম রফতানি হবে। ক্রেতারা দেশের আমের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এসিআইসহ ৬৫ জন উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠান বিদেশে আম রফতানি করছে।’

জানা গেছে, এবছর দেশের ৯৩০ জন কৃষি উদ্যোক্তা বিদেশে রফতানির জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আম উৎপাদন করছেন। ‘রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের’ আওতায় কাজটি হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় প্রথমবারের মতো উদ্যোক্তাদের প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে। এ বছর ৯৩০ জন উদ্যোক্তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। আগামী ৪ বছরে সংখ্যাটি ৮ হাজার ৪০০ জনে উন্নীত হবে। অর্থাৎ এ বছর বিশেষভাবে উৎপাদিত ৯৩০ জন উদ্যোক্তার আম বিদেশে যাবে। এর বাইরে প্রতিবারের মতো অন্যান্য উদ্যোক্তাদের আমও বিদেশে যাবে।

কয়েক বছরের আম উৎপাদনের চিত্র
গত কয়েকবছর ধরে দেশে আমের উৎপাদন ২১ থেকে ২৪ লাখ টনে উঠানামা করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে আমের উৎপাদন হয়েছিল ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৫০০ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন ছিলো ২৩ লাখ ৭২ হাজার ২০০ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২ লাখ ২৯ হাজার টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৪ লাখ ৬৮ হাজার টন ও ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২৩ লাখ ৫০ হাজার ৪৯০ টন। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমের উৎপাদন ছিলো ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৩১৫ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১১ লাখ ৬৫ হাজার ৮০৪ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪৫০ টন ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২ লাখ ২২ হাজার ৩৬৮ টন।

দেশে আমের উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি না পেলেও ফলটির উৎপাদন বাড়াতে সরকার কাজ করছে। আমসহ বিভিন্ন ফলের উৎপাদন বাড়াতে ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ শীর্ষক অপর একটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে কৃষ সম্প্রসারণ অধিদফতর।

এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মেহেদী মাসুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমের উৎপাদন বাড়াতে আমরা বিভিন্ন প্রদর্শনী করে থাকি। উচ্চফলনশীল জাতের আম গাছের বাগান করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ বছরও প্রায় ১২০ টি প্রদর্শনী ছিলো। আম রুপালী, গোবিন্দভোগ, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, জাদুভোগসহ বিভিন্ন জাতের আমের প্রদর্শনী করা হয়। আগামী বছর দেশের বিভিন্ন যায়গায় আরও বেশি প্রদর্শনী করা হবে। এতে ধীরে ধীরে দেশে আমের উৎপাদন বাড়ছে। উচ্চফলনশীল জাতের আমের প্রসার ঘটছে। ভবিষ্যতে আমের উৎপাদন আরও বাড়বে।’

আম রফতানিতে বাধা
সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ সত্ত্বেও আম রফতানিতে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। উদ্যোক্তারা জানান, ফার্মার সার্টিফিকেট ও ফাইটো স্যানিটারি সার্টিফিকেট প্রাপ্তি আম রফতানিতে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের অব্যবস্থাপনাও আম রফতানির পথে বাধা। এছাড়া উড়োজাহাজের ভাড়াও আম রফতানির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শীর্ষ আম রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘লি এন্টারপ্রাইজে’র মালিক আবুল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বছর এখনও আম রফতানি শুরু হয়নি। আম এখনও রফতানিযোগ্য হয়নি। জুন থেকে আম রফতানি শুরু হবে। আম রফতানিতে অনেক বাঁধা রয়েছে। আম রফতানির সার্টিফিকেট আনতে হলে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেতে হয়। এজন্য আন্ডারটেবিল মানিও দিতে হয়। সেন্ট্রাল প্যাকেজিং হাউজে কিছুই নেই। কোনো স্পেস নেই, লাইটিংয়ের ব্যবস্থা নেই। আমের গ্রেডিং ঠিকভাবে করা যায় না। অন্তত ২০ জন আম রফতানি করে, ২০টি রুম লাগবে, সেটি নেই।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সরকার প্যাকেজিং হাউজে নজর দিচ্ছে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। তাদের সব কিছুর জন্য আন্ডার টেবিল মানি লাগে।’

বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মো. মনজুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ক্লাস্টার করে আম রফতানি করছি। গত বছর ১ হাজার ৮২০ টন আম রফতানি হয়েছে। ৪০ থেকে ৫০টি প্রতিষ্ঠান আম রফতানির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। গত ১০ বছর ধরেই আমরা আম রফতানি করছি। এ বছর আম রফতানি আরও বাড়বে।’

আম রফতানির পথে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফাইটো স্যানিটারি সার্টিফিকেট পেতে আমাদের দীর্ঘ সময় লাগে। এটি পেতে অনেক বেগ পোহাতে হয়। আর রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশ ভারত, পাকিস্তান বা থাইল্যান্ডের উড়োজাহাজ ভাড়ার চেয়ে আমাদের দেশ থেকে ভাড়া অনেক বেশি।’

সবজি, ফল ও অন্য পণ্য রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রুটস-ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আম রফতানির বিষয়টি আমদানিকারক দেশের চাহিদার উপর নির্ভর করছে। আবার দেশের পরিবহন ব্যবস্থা ও আমের উৎপাদনের উপরও নির্ভর করে। যখন আমাদের পাঠানো আম বিভিন্ন দেশে যাবে, তখন আমদানিকারকরা সেসব আম কেনার পর, তা যদি বিক্রি করতে পারে; তবেই তারা নতুন করে চাহিদা পাঠাবে। পাশ্ববর্তী ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আম রফতানি হয়। আমাদের আমের তুলনায় তাদের আমের দাম কেমন, তার ওপরও রফতানি নির্ভর করে।’

প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গাছ থেকে আম পাড়ার একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। শিডিউল অনুযায়ী আম পেড়ে ফার্মার সার্টিফিকেট নিতে হয়। তার পর প্যাকিং হাউজ থেকে আবার সার্টিফকেট নিতে হয়। অনেক সময় ভালো আমকেও সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না। এটি একটি প্রতিবন্ধকতা।‘

কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের উপপরিচালক এস এম খালিদ সাইফুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোয়ালিটি আম পাঠাতে সার্টিফিকেট লাগবে। ফার্মার সার্টিফিকেট লাগে। আমরা ধীরে ধীরে ইউরোপের সুপারশপে যাচ্ছি।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের জেনারেটর এখন নষ্ট। এটি ঠিক হতে সময় লাগবে। আমাদের এখানে রুমও কম। বিল্ডিংয়ে জায়গা নেই। পূর্বাচলে আধুনিক পরিসরে প্যাকিং হাউজ নির্মিত হলে এই সমস্যা কেটে যাবে।’

অনৈতিক বা ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘এটি তো প্রমাণিত নয়। তবে ময়লা পরিষ্কার করার জন্য রফতানিকারকরা টাকা দিয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্যাকিং হাউজের বিদ্যুৎ, রুম ব্যবহারের জন্য টাকা দিতে হয়। যেহেতু আমরা রফতানি বাড়াতে চেষ্টা করছি তাই এই সেবা বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আমরা এর জন্যও চার্জ করবো।’

উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশে আমসহ বিভিন্ন পণ্য রফতানিতে আমাদের নানা নিয়ম মেনে চলতে হয়। আমরা সেসব নিয়মের ব্যতয় ঘটতে দেই না। নিয়ম মেনে উদ্যোক্তাদের সব ধরণের সহযোগিতা করা হচ্ছে।’

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.