শেষ হয়েও হয় না শেষ ।। অলক চক্রবর্তী

হরতনের বিবি ইস্কাপনের গোলাম- প্রদীপ আচার্য।

প্রথম প্রকাশ- ফেব্রুয়ারি—২০২২।

প্রকাশন- অমরাবতী 

প্রদীপ আচার্যের প্রথম বই এটি। ১৩ টি গল্প নিয়ে এই বইটি সাজানো। গল্পগুলো হলো- হরতনের বিবি ইস্কাপনের গোলাম, বিন্নিধানের খই ও কতিপয় স্বপ্নখাদক, ব্ল্যাকবোর্ড, ফেরা, জলজ গাথা, ঘুমে ডুবে যায় কবিয়াল চোখ, মগ্নতায় বিবর্ণতা, লাইফসাপোর্ট, ভালোবাসা সুদূরের নাম, করোটিতে ঘুণপোকা—ঘোর, নিলীন, মানুষ, অতঃপর শূন্যে দাঁড়িয়ে।

একেকটি গল্পে প্রদীপ পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন এক সীমাহীন আবিস্কারের দিকে। এ যেমন কাহিনীর নতুনত্বে তেমনি তার বাক্যশৈলীর মাধ্যমে।
বাক্যের মধ্যে অনায়াসে ঘোর তৈরি করতে পারেন তিনি। বলা যায় এ তাঁর ভাষার জাদু। ‘মগ্নতায় বির্বণতা’ গল্প থেকে যদি উদ্ধৃতি দেই তাহলে পাঠকও বুঝতে পারবেন-‘প্রতিদিনের ট্রেনটা বটতলী স্টে্রশনের কাছাকাছি এসেই ক্লান্তিতে হাই তোলে। উত্তরের পাহাড় আর সারিসারি উঁচু ছায়াদের কাছাকাছি এসে ট্রেনটা সবুজ নিঃশ্বাস নিতে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়; আর তখনই আমি টুপ করে নেমে পড়ি দেওয়ানহাট ওভারব্রীজের নিচে। নামতেই স্বস্তি। ট্রেনকে ফাঁকি দিয়ে স্টেশনবিহীন পথে গন্তব্যের কাছাকাছি থাকতে পারার নিশ্চয়তা মনকে চনমনে করে তোলে। চলন্ত ট্রেন থেকে নামতে প্রথম প্রথম ভয় পেতাম, ক্রমশ চৌকস হয়েছি এ খেলায়।
সামান্য বিষয়কে নিয়েও তিনি তরতর করে এগিয়ে যান বিষয়ের গভীরতার দিকে-এবং অন্তর্দৃষ্টিতে দেখান সেখানের পূঙ্খানুপুঙ্খ চিত্রগল্পের বিষয় হলো এক ছেলে রাস্তায় বসে মাছ বিক্রি করে। আর গল্পের উত্তম পুরষ প্রতিদিন তাকে চাকরি থেকে ফেরার পথে দেখতে পান। হয়তো সামান্য ওখানে জিরিয়ে নেন। সেই ফাঁকে একটুখানি আলাপ—
‘দেওয়ানহাট ব্রিজের নিচে গড়ে ওঠা গোটা দশ—পনেরো ঝুপড়ির একটিতে সে আর দাদি থাকে। মেঘনার ভাঙনে সব নদীর পেটে গেলে সে চট্টগ্রামে এসেছিল বাবার কোলে চড়ে। কবে, সেটা সঠিক বলতে পারে না। হাতের ইশারায় উচ্চতা দেখায়। তার বাবা নাকি রিক্সা চালাত, ট্রাকের ধাক্কায় রাস্তায়ই মরে পড়েছিল লোকটা। ঘটনাটা এতটাই নির্বিকারভাবে বলে সে, যেন ট্রাকের ধাক্কায় বাবার এই মৃত্যু খুবই মামুলি এক ব্যাপার তার কাছে, নিতান্তই সাধারণ। বরং বাবা মারা গেলে মায়ের আবার বিয়ে করাটা তার বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে ওঠে, দুচোখে প্রবল বিস্ময় নিয়ে ব্যাপারটার বিশদ বয়ান করে সে। তার মা, শীতের এক ঘোরলাগা সন্ধ্যায় কপালে বড় লালটিপ লাগিয়ে, পরনে লালডুরে শাড়ি পেঁচিয়ে, আধহাত ঘোমটা টেনে ওভারব্রীজের ওপর থেকে ঝুঁকে আছে নিচে, হাত নাড়ছে তার দিকে তাকিয়ে। মায়ের অন্যহাত জড়িয়ে আছে অচেনা এক পুরুষের শক্ত বাহু। দুচোখে প্রবল বিস্ময় আর অবিশ্বাস নিয়ে সে দেখছে মায়ের এই অচেনা, অপরিচিতরূপ।’—(মগ্নতায় বির্বণতা)।
এখানে কি অসাধারণ বর্ণনা করেন লেখক! আর এ কারণে যেনো আমরাও দেখতে পাই— শীতের এক ঘোরলাগা সন্ধ্যায় কপালে বড় লালটিপ লাগিয়ে, পরনে লালডুরে শাড়ি পেঁচিয়ে, আধহাত ঘোমটা টেনে ওভারব্রীজের ওপর থেকে ঝুঁকে আছে নিচে, হাত নাড়ছে কেউ।
গল্পের মাধ্যমে তিনি সমাজের ঐতিয্যগুলো তুলো ধরেন নিখুঁত বর্ণনায়।
‘আশ্বিনের শেষ দিন। পড়ন্ত দুপুর থেকেই চৌধুরী বাড়িতে ব্যস্ততার শুরু। ততক্ষণে নারকেলগাছ থেকে নারকেল পেড়ে বাড়ি বাড়ি ভাগবাটোয়ারা শেষ। গোটা বিশেক পরিবারের এ বাড়িতে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি প্রিয়ব্রত চৌধুরী। বাইরের বারান্দায় পলকহীন সামনের দিকে তাকিয়ে তিনি কি খোঁজেন বোঝা দায়—’ (বিন্নি ধানের খই ও কতিপয় স্বপ্নখাদক)।
অনেক গল্প তিনি বড় ক্যানভাসে ধরেন। প্রথমে মনে হবে কোনো উপন্যাসের শুরু। ফলে উঠে আসে চমৎকার চিত্রকল্পÑপ্রকৃতির নিটোল বর্ণনা। তাঁর এ চিত্রকল্প প্রতিটি গল্পেই ছড়িয়ে—ছিটিয়ে আছে। কিন্তু তিনি সঠিকভাবেই তাঁর গল্পের পরিসরেই আবদ্ধ থাকেন লক্ষ্যের মাত্রায়। এ বইয়ে বড় গল্প এবং ছোট গল্প দুই—ই আছে।
বিষয়বস্তুর দিক থেকে বলতে গেলে সমাজের ঘটমান সমসাময়িক বিষয়গুলো তাঁর গল্পে গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। কত রকম বিষয়ের অবতারণা করেছেন লেখক এই বইতে, যেমন— করোনা মহামারি, সাম্প্রদায়িক বিষ—বাষ্প, দারিদ্রতার কষাঘাত, মাদকের নিষ্টুর থাবা, আদিম বাসনার লোলুপতা—ইত্যাদি। আবার এর ভেতরেই মানুষের অবস্থান এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন তিনি তুলে ধরেছেন অবলীলায়।
‘সুহাসিনীর আবছা ছায়া তিলকের পাশ দিয়ে যেতেই তাকে কাছে টানতে চায় তিলক। সুহাসিনী নিজেকে যত ছাড়িয়ে নিতে চায় দূরত্ব কমে আসে তত।
হাসু, অশ্বিনীকুমারের কাছে বর মাগুম তুমি যেন আমার হইয়া যাও— ধরা গলায় বলে তিলক।
এখন ছাড় তো! —তিলককে আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত ছুট লাগায় সুহাসিনী।— (বিন্নি ধানের খই ও কতিপয় স্বপ্নখাদক)।
প্রেমের কি অসাধারণ বর্ণনা। এরপর সুহাসিনীর গল্পের একপর্যায়ে ভাইকে রাতের আঁধারে খুঁজতে গিয়ে ধর্ষিত হয় এবং এরপরের অংশটি আবার উদ্ধৃত করছি পাঠকদের জন্য—
‘অবশ, চেতনাহীন পড়ে থাকে সুহাসিনী। অবচেতন মনে স্মৃতি বিলিকাটে, স্মৃতি তাকে নিয়ে যায় বিয়ের ছয় মাসের মাথায়—স্বামীর নিথর শরীর চিতায় তুলে দেয়ার মুহূর্তটুকুতে। তার মনে হয় কোথাও ঝড় উঠেছে ভীষণ, ঘৃণা আর ক্ষোভের তীব্র তোলপাড়ে ডুবে যাচ্ছে তার বোধের পারদ। চোখের কোণ বেয়ে নামা গরম জলের ধারায় শুকনো মাটি ভিজে ওঠে অনেকটা। মাটিতে লেপ্টে থাকে ছোপ ছোপ রক্ত। শেষবারের মতো তিলকের কথাগুলো কানে বাজে সুহাসিনীর, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসে, হাসু, অশ্বিনীকুমারের কাছে বর মাগুম, তুমি যেন আমার হইয়া যাও…’
আমাদের কানেও আসে এই করুণ আকুতি। এইভাবে লেখক গল্পের ইতি টানেন।
লেখক যেমন এ বইয়ে সম্ভ্রান্ত জীবনের কাহিনী তুলে ধরেন পাশাপাশি দরিদ্র—নিম্নবৃত্ত জীবনের ঘটনাও চিত্রায়ন করেছেন একনিষ্ঠতার সঙ্গে। কোথাও একবারের জন্যও মনে হয় না লেখক এখানে আগুন্তুক। বরং মনে হয়েছে তিনি এ সমাজেরই একজন। অর্থাৎ তিনি এ জীবনগুলো অত্যান্ত নিবিঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এখানেই লেখক হিসেবে তাঁর সফলতা। সমাজের নানা ঘটনা তিনি তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখে চরিত্রের সঙ্গে বিলীন হয়ে যান এখানে তাঁর লেখক—সত্ত্বার শক্তি নিরুপণ করা যায়।
‘ভালোবাসা সুদুরের নাম’ গল্পের আমিকে আমির সামনে দাঁড় করিয়ে দেন— ‘বাড়ীর সামনের এ রাস্তা আমার আজন্ম পরিচিত। চৈত্রের মাঝামাঝির এই সময়টাতে দু’পাশের গাছের শিমুল তুলো পুরো পথটাকে সাদা করে রাখে। আমি দেখি, জুলি নামের কোনো এক শিশু সে পথে পড়ে থাকা তুলো তার ছোট্ট আঙুলে তুলে শুন্যে উড়িয়ে দেয় আর ফুঁ দিয়ে চলে তার শৈশব—কৈশোরের পথ। আমি খানিক থমকে দাঁড়িয়ে দেখি গ্রামীণ সে প্রকৃতি কন্যাকে। এমন নির্জনে রাস্তার দু’ধারের ঝোপে ঝিঁঝির ডাক দুপুরের নীরবতাকে আরো গাঢ় করে। ভর করে আমার মনের লালিত শূন্যতায়। কোথাও কোনো জনমানব চোখে পড়ে না। কেবল চোখে পড়ে কাঁঠাল গাছে অগণিত নবীন কাঁঠাল, কাঁচা—সবুজ রঙে হাসে। এমন নীরবতা আজ অচেনা লাগে ভীষণ।
কে প্রশ্ন করে? দুলে ওঠা পাতারা, বয়ে যাওয়া বাতাস, নাকি আমার ভেতরেই কোনো এক অন্য আমি! আমি আড়ষ্টস্বরে বলি, কেন! তাদের তো বাবা আছে, বাবার কাছেই থাকবে!’— (ভালোবাসা সুদুরের নাম)

‘ব্ল্যাকবোর্ড’ গল্পে করোনায় এক শিশু মারা যাওয়ার করুণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তারই সহপাঠী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। সে স্বপ্নে তার সমবয়সী রঞ্জনাকে দেখতে পায়। দেখতে পায়—‘দু’জনে সর্পিল ভঙ্গিমায় এক গাছ থেকে অন্য গাছের দূরত্ব দৌড়াতে দৌড়াতে মাড়িয়ে বারান্দা পেরিয়ে এসে দাঁড়ায় তাদের শ্রেণিকক্ষের সামনে। পঞ্চম শ্রেণি ক শাখা। তাদের ক্লাসে ঢোকা ও বের হবার দুটি দরজা। একটি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, অন্যটিতে ছোট্ট একটি তালা। দু’জনে জানালার ভাঙা কাঁচের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় ক্লাস রুমের ভেতর।
কতদিন হলো ক্লাসে ঢুকি না, ইস! কবে যে স্কুল খুলবে!— আক্ষেপ করে টগর।
ক্লাসে ঢুকবি? চল তালা ভেঙে ঢুকি! —রঞ্জনার সোজা জবাব।
অই ভিতুর ডিম, তোর এত সাহস কোথা থেকে হল? — অবাক প্রশ্ন টগরের।
আমি ম্যাজিক করে ভেতরে ঢুকে যাব, ঢুকবি?’
স্কুলে নানা বৈচিত্রময় ঘটনার পর তার ঘুম ভাঙ্গে। এবং টগর তখন সত্যিই স্কুলে গিয়ে দেখতে চায় রঞ্জনা ব্ল্যাকবোর্ডে কিছু লিখেছে কিনা। তার মা স্বপ্ন দেখার কথা বলার পরেও সে মাকে সরিয়ে স্কুলের দিকে দৌড় দেয়। গল্পটি আমাদের মনকে আদ্র করে তোলে। কিন্তু প্রদীপ আচার্য স্বপ্নকে স্বপ্নের রঙেই রাঙিয়ে তোলেন নিপুণ শিল্পীর তুলিতে।

সাম্প্রদায়িকতার বিষয় নিয়ে ‘ফেরা’ গল্পটিও পাঠকের ভালো লাগবে। সাম্প্রদায়িক ঘটনার সময় গফুর নামে একজন এগিয়ে আসে তার আবাল্য বন্ধুকে বাঁচাতে। তার কাছে তখন জাত—ধর্ম প্রাধান্য পায়নি। ‘তখন ছিল বসন্ত। ফাগুনের রাত। প্রায় একটা। তখনো শীত যায় যায় করেও রেশ ছিল খানিকটা। পুরো গ্রাম ঘুমে। হঠাৎ তীব্র চিৎকারে ঘুম ভাঙে গফুরের। বাইরে এসে দেখে পাড়ার পুবের শেষ মাথায় আগুন। ব্যাপারটা বুঝতে আর একমুহূর্তও লাগে না তার। এ মাটির ওপর অনেক আগেই চোখ পড়েছিল সিকদার ব্যাপারির। নিরঞ্জনের পৈত্রিক ভিটে, সুধারাম কাকার জন্মও নাকি এ মাটিতেই। অন্ধকারে সেদিকে দৌড়াতেই গফুরের সাথে ধাক্কা লাগে কারো। চিনতে পারে গফুর। এ গাঁয়ে কী করে জলিল! পেছন থেকে নিরঞ্জন বলে উঠে, গফুর! ধর! ধর! এরা সিকদার ব্যপারির লোক! আগুন লাগিয়ে পালাচ্ছে! … নিরঞ্জনকে সাহায্য করতে জলিলকে বাগে আনার চেষ্টায় এতটুকু দেরি হয় না গফুরের। ধস্তাধস্তিতে জলিলের এক সাথীর লাঠির আঘাত এসে লাগে নিরঞ্জনের বাম কাঁধে। জলিলের শক্তির কাছে নিরঞ্জন অসহায় আত্মসমর্পণ করে অগত্যা। জলিলকে জাপটে ধরে তার হাতের লাঠিটা ছাড়িয়ে নিয়ে গফুর তার পিঠে বসিয়ে দেয় এক ঘা। ততক্ষণে জলিল আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে পিছলে পড়ে। লাঠির আঘাত তার পিঠে না লেগে সোজা মাথায় গিয়ে লাগে। জলিল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর ক্রমশ তার শরীর শিথিল হয়ে আসে। আগুনের শিখা কমে আসে, মাটিতে পড়ে থাকা জলিলের মাথার চারপাশে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ কালচে হয়। খুন, খুন! পালা, গফুর পালা! গফুর পালায়নি। সে যদি পালাত সেদিন, নির্দোষ নিরঞ্জনকে তাহলে ছেড়ে কথা বলত না সেদিন কেউ। নিরঞ্জনকে বইতে হতো গফুরের শাস্তির ভার। গফুর সেটা চায়নি। নিজের অপরাধের শাস্তি নিরীহ নিরঞ্জনের ওপর চাপাতে সায় দেয়নি তার মন। সেদিন না পালানোর সেই ভাবনাটা গফুরকে আজও তৃপ্ত করে।’— ‘ফেরা’।
সমাজের এই মানুষগুলোর কথা পর্দার আড়ালে থেকে যায়। প্রদীপ আচার্য এ চরিত্রকে সামনে নিয়ে এসেছেনÑযখন আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানুষ সাম্প্রদায়িকতাকে উপজীব্য করে ফায়দা লুঠতে চায়। সংখ্যায় কম হলেও এ ধরনের চরিত্র আছে আমাদের সমাজে। আমাদের চারপাশেই এরকম বন্ধু—বান্ধব নেহায়েত কমও নয়।
কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখী ঘটনার গল্প ‘করোটিতে ঘুণপোকা—ঘোর’। কখনো কখনো এমন ঘটনার মুখোমুখী হতে হয় আমাদের তখন কোনো ভাষা থাকে না, কি করণীয় বুঝতে পারা যায় না। কিন্তু লেখক নিজেকে নিরন্তর নিরীক্ষার মধ্যে রেখেছেন—সংকটের মুখোমুখী হয়েছেন কি অনায়াসে।
‘জেরিনকে প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর মেলে না। তবে কি বাবা—মার এ সময়টাতে আলাদা থাকাই তার মনোকষ্টের কারণ! নিজেকেই প্রশ্ন করে সোনিয়া। খালিদ এসব ভাবে না কোনোদিন। খালিদ একটু বুঝলে তাদের জীবনটা অন্যরকম হতো। কী করবে ভেবে পায় না সোনিয়া। ভাবতে থাকে। সোনিয়ার ভাবনায় ছেদ ঘটায় আকলিমা। বলে, দাদু আসার পর থেকে জেরিন অন্যরকম আচরণ করছে। সে দাদুর সাথে ঘুমাতে চায় না। দাদুু প্রতিদিন দুপুরে তাকে এক প্রকার জোর করেই ঘুমাতে নিয়ে যায়। সে সময় দাদু রুমের দরজাও বন্ধ রাখে। আকলিমার কথাগুলো শুনে সোনিয়ার মাথা ঘুরতে থাকে। সে কি বলবে বুুঝতে পারে না। নিজে যা ভাবছে সে, সে ভাবনাও বিশ^াস করবে কিনা বুঝতে পারে না। দ্বিধা তার ভেতরে এক গোপন ঝড় তোলে। আকলিমা বলে, সে ভয়ে কথাগুলো খালিদকে জানায় নি। সোনিয়ার মুখ থেকে রক্ত সরে যায়। ফ্যাকাসে, রক্তহীন দেখায় তাকে। বধির মনে হয় তার নিজেকে। শেষে স্থির হয় ভাবনায়। না, মনকে শান্ত করতেই হবে। জেরিনকে নানাভাবে জিজ্ঞে্যস করেও কোনো জবাব মেলে না। কী করবে সোনিয়া! আবার কি ফিরে আসবে সে? সন্তানের কথা ভেবে কি চাকরিটাই ছেড়ে দেবে? কীভাবে তার সন্তান বেড়ে উঠবে নিরাপদে? খালিদকে কি বলা যাবে এসব? খালিদ এসব বিশ^াসই করবে না। এমন ভাবনা খালিদ কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাববে না। না… এভাবে চুপ থাকা যাবে না। তাকে কিছুটা নমনীয় হতেই হবে। সে যে মা। খালিদকে মনে মনে কাঠগড়ায় দাঁড় করায় সোনিয়া, বলে, খালিদ! এ কোন যুদ্ধে নামিয়েছ মা—মেয়ে দু’জনকেই! এ কেমন যুদ্ধ!’—এ যখন অবস্থা তারপর একজন
শিশু—মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর লেখকের ভাষায় শুনি—‘সবাই চুপচাপ। তিনজনই মোটরকারের পিছনের দিকে বসা, জেরিন বাবা—মার মাঝখানে। জেরিনের মুখের দিকে তাকাতে পারে না খালিদ। জেরিন গাড়ীতে পুরো সময় মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে। খালিদের বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়ি পেটায়, আর বলে, আমি আমার সন্তানকে আগলে রাখতে পারি নি। আমি এক ব্যর্থ পিতা।
বাসায় ফিরে খালিদ তার আব্বাকে বলে, আব্বা আপনি কাল সকালে গ্রামে ফেরত যাবেন, আর না বলা পর্যন্ত ঢাকায় কখনও আসবেন না।’

তাঁর গল্পের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো তাঁর গল্পের শেষ মূহূর্তগুলো— যেনো মনে হয় শেষ হয়েও হলো না শেষ। এখানে তিনি পাঠকের জন্য অবশিষ্ঠাংশটুকু রেখে দেন।
তার গল্পে প্রকৃতির যে চিত্রকল্প ফুটে উঠে তা অসাধারণ। নিখুঁত বর্ণনায় মানুষের চরিত্রের স্ব—বিরোধী এবং অনুদ্ভাসিত দিকগুলো তিনি দু’একটা বাক্যের আঁচড়ে তুলে ধরেন।
এত টানাপোড়েনের মধ্যেও তিনি খেই হারান না, বরং পরিমিতির মধ্যে সেই বিষয়গুলো বা সংকটগুলো মোকাবেলা করেন খুব সহজে। এরকম অসংখ্য ভালোলাগার উদ্ধৃতি দেওয়া যায় এই বইটি থেকে। দু’একটা জায়গায় মুদ্রণজনিত ত্রুটির কারণে শব্দ আলাদা হয়ে যাওয়ায় পাঠকের প্রথমত বুঝতে অসুবিধা হলেও পরিশেষে বলা যায় নানা বিষয়—বৈচিত্রে সমৃদ্ধ বইটি পাঠকের নিঃসন্দেহে ভালো লাগবে।

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.